You dont have javascript enabled! Please enable it!

বহ্নিমান ধূমাৎ

ছায়া পূর্বগামিনী । এমন যে ঘটিবে, তাহা কয় সপ্তাহ আগেই জানা গিয়াছিল। সূত্রপাত-পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানের ব্যাপক সমরসজ্জা। পাকিস্তানে প্রায় এক কোটি নাগরিককে ভারতে ঠেলিয়া দিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, নিঃশব্দ আক্রমণের পর সীমান্তের ওপার হইতে ভাসিয়া আসে রণবাদ্য। তাহার জবাবে স্বভাৰত ভারতকে সাড়া দিতে হইয়াছে। আত্মরক্ষামূলক প্রস্তুতি চলিয়াছে সীমান্তের এপারেও। এই প্রস্তুতির যে প্রয়ােজন ছিল, ‘তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে হাত পা গুটাইয়া লইলে তাহা যে জাতির পক্ষে আত্মঘাতী হইত, পূর্ব সীমান্তে বয়ড়া অঞ্চলের ঘটনাবলি তাহার প্রমাণ। বয়ড়া কলিকাতা হইতে মাইল পঞ্চাশ ঘুরে হঠকারী হানাদার দল নিশ্চয়ই প্রমােদ ভ্রমণের জন্য ভারতের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে নাই। জবাবও মিলিয়াছে সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের সতর্ক ন্যাট-বাহিনী দুঃসাহসী স্যাবারজেট-বাহিনীকে ছত্রখান করিয়া দিয়াছে। তিনটি পাক বিমান ধ্বংস, দুইজন জঙ্গী পাইলট বন্দী। প্রহরা নিঃসন্দেহে নিচ্ছিদ্র। আমাদের বীর বৈমানিকদের অভিনন্দন। মাহিয়া পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করিয়াছেন। যেন এতকাল পাকিস্তানের অবস্থা খুব স্বাভাবিক এবং সহজ ছিল। প্রায় এক যুগ ধরিয়া যে দেশে কার্যত সামরিক শাসন বহাল সেখানে তথাকথিত এই জরুরী অবস্থা ঘােষণায় নাগরিক জীবনে গুণগত পরিবর্তন বিশেষ ঘটিবে না। তবে হ্যা, ডিসেম্বরে যে জাতীয় পরিষদ বসিবার কথা তাহা না বসাইবার পক্ষে ইয়াহিয়া খাঁ একটি যুক্তি সংগ্রহ করিলেন হয়তাে। তিনি জরুরী অবস্থা ঘােষণা করিয়াছেন নাকি “বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দেখিয়া । রীতিমত নাটক। বুঝিতে অসুবিধা নাই ইয়াহিয়া চমক সৃষ্টি করিতে চাহেন। “বৈদেশিক আক্রমণ” বই কি। ইয়াহিয়া খাঁর কাছে মুক্তি যােদ্ধাদের আক্রমণ মাত্রই” “বৈদেশিক আক্রমণ” । তিনি এবং তাঁহার প্রচার যন্ত্রগুলি তারস্বরে চিৎকার করিতেছেন,- পূর্ববাংলায় বিদেশীরা হানা দিতেছে, এবং পাকিস্তানী বাহিনী তাহাদের বেদম প্রহার করিতেছে। অথচ এদিকে তামাম দুনিয়ার পর্যবেক্ষকরা বলিতেছেন- বাংলাদেশ গেরিলাদের আক্রমণে পাকবাহিনী ক্রমেই কোনঠাসা, আজ তাহাদের হাতে সুবা বাংলার তিন ভাগের এক ভাগও আছে কিনা সন্দেহ। ছাউনি আর কিছু প্রধান সড়ক ছাড়া হানাদারদের জন্য সব পথ বন্ধ । ইয়াহিয়া জানেন- এবার যাহারা ক্যান্টনমেন্ট অবরােধ করিয়াছেন, তাঁহাদের সঙ্গে মার্চের অবরােধকারীদের অনেক পার্থক্য। সেদিনে স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহীরা আজ সু-সংগঠিত বাহিনী এবং সে বাহিনী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ।

সুতরাং খানসেনাদের ভবিষ্যৎ অনুমান করা দুঃসাধ্য না । পরাজয়ের চরম মুহূর্ত যত আগাইয়া আসিবে নিয়তি ইয়াহিয়া খাকে ততই ভারতের সঙ্গে সর্বাত্মক লড়াইয়ের দিকে ঠেলিয়া দিবে। স্যাবার জেট-এর মৃত্যু, ঘটা করিয়া জরুরী অবস্থা ঘােষণা, এসব কি তাহারই ইঙ্গিত নয়? ইয়াহিয়া খাঁ ইতিপূর্বে নিজেই স্বীকার করিয়াছেন দুই দেশের মধ্যে অঘােষিত যুদ্ধ চলিতেছে। এবার কি সাড়ম্বরে আনুষ্ঠানিক ঘােষণা?  হয়ত এখনই তিনি তাহা করিবেন না কারণ, এই যুদ্ধের পরিণতি কী তিনি তাহা ভাল করিয়া জানেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অগ্রিম জানাইয়া রাখিয়াছেন, পাকিস্তান তৃতীয়বার ভারত আক্রমণ করিলে এবার লড়াই হইবে পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়াইয়া এবং পূর্বসীমান্তে আমাদের জওয়ানরা জানাইয়া দিলেন। চোরাগােপ্তা আক্রমণের জন্যও আর নগদ মূল্য গুনিয়া দেওয়া ছাড়া গতি নাই। সুতরাং পাকিস্তান হয়তাে আপাতত গল্পের সেই রাখাল বালকের মত পালে বাঘ পড়িয়াছে বলিয়া বিস্তর গােল করিবে। ভারতের সঙ্গে একহাত লড়িবার ইচ্ছা তাহার একাধিক কারণে। বাংলাদেশ হইতে হটিবার পক্ষে সেটা একটা সুযােগ। দ্বিতীয়ত-যদি পারা যায় আগুন জ্বালাইয়া আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আদায় করা। ইতিমধ্যে কৌশলে যদি কোনও ভারতীয় এলাকা হস্তগত করা যায়, তবে তাে কথাই নাই- দরকষাকষির সুযােগ মিলিতে পারে । পাকিস্তান এই জুয়া খেলাই খেলিতে বসিয়াছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদও এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন, পাকিস্তান বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাইবার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করিতে চাহে। যুদ্ধ এড়াইবার সুযােগ তাহার ছিল। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলিয়াছেনপাকিস্তানের উচিত, সময় থাকিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনায় বসা। শােনা যায়, বন্ধুবর্গের তাহাই পরামর্শ। কিন্তু পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী সে পথে যায় নাই। ঈদে ইয়াহিয়া খা ভারতকে শুভেচ্ছা জানাইয়াছেন বটে, কিন্তু মুজিবকে মুক্তি দেন নাই। উপরন্তু তাহার এমনই ঔদ্ধত্য যে ভারতের আকাশে জঙ্গী বিমান পাঠাইয়াছেন।

বিমানগুলি ভূপাতিত হইয়াছে ভারতীয় সীমানার পাঁচ কিলােমিটার ভিতরে। সুতরাং রাষ্ট্রপুঞ্জে যদি পাকিস্তান হৈ হল্লা বাধাইবার চেষ্টা করে, তবে ভারতকে নিঃসঙ্কোচে জানাইয়া দিতে হইবে- এ ব্যাপারে কোনও ফোপরদালালি চলিবে না। দীর্ঘ আট মাস যে বিশ্বসভা নাকে তেল দিয়া ঘুমাইয়াছে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ভারতের ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্কিতেও যাহার চৈতন্যেদয় হয় নাই, তাহার পক্ষে হঠাৎ লাফ দিয়া উঠিয়া মোড়লি করা সাজে না। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি খােলাখুলি বলিয়াছেন- ভারত বাংলাদেশে বারাে ডিভিসন সৈন্য পাঠাইয়াছে, এটা সম্পূর্ণ আজগবি ব্যাপার। তাহার পরামর্শ- পাকিস্তানকে নিজের ঘর সামলাইতে বলুন। উথান্ট যে তড়িঘড়ি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকেন নাই তাহাতে নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নাই। পাকিস্তানের মামা মেসােরা অবশ্যই কোনও না কোনওভাবে সাড়া দিবেন। তাই বলিয়া ভারতকে চুপ থাকিলে চলিবে না। ইয়াহিয়া খাঁর লজিক যখন তাহাকে মৃত্যুবর্ষী স্যাবার-জেট পাঠাইতে বলিতে পারে, তবে আমাদের “ন্যাট” তাহাকে নামাইয়া আনিবেই । যদি সেটা “যুদ্ধ” হয়, তবে ভারতীয় জনসাধারণ নির্দ্ধিধায় এই যুদ্ধকে মাতৃভূমি রক্ষার মহান ব্রত বলিয়াই গ্রহণ করে।

Reference:

২৫ নভেম্বর, ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!