You dont have javascript enabled! Please enable it!

নাই দেরী নাই

লখিন্দর তাহার লােহার বাসরঘরে থাকিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন যে, কোন সাপ আর তাঁহাকে দংশন করিতে পারিবে না। নিচ্ছিদ্র ও নিরেট লােহার বাধা ভেদ করিয়া সেই বাসর ঘরে সাপের প্রবেশ নিতান্ত অসম্ভব বলিয়া তাঁহার ধারণা ইয়াছিল। কিন্তু তিনি ভুল ধারণা করিয়াছিলেন। লােহার বাসরঘরের নিভৃতে থাকিয়াও তিনি নিরাপদ হইতে পারেন নাই। সাপ সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে দংশন করিয়াছিল। কাহিনীর শিক্ষা বােধহয় ইহাই যে, নিয়তির আঘাত হইতে রক্ষা পাইবার কোন উপায় নাই । নিয়তির ইচ্ছাতে লােহার বাসরঘরেও প্রবেশ করিবার সূক্ষ্ম ছিদ্রপথ থাকে। ঢাকাতে ইয়াহিয়ার দালাল প্রকাশকদিগের সাম্প্রতিক সতর্কতার ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করিলে লখিন্দরের কাহিনীর ওই ঘটনাটির কথা মনে পড়িতে পারে। গভর্ণর মালিক সাহেব সামান্য দূরত্বের এখানে ওখানে যাইতে হইলে হেলিকপ্টারে যাইতেছেন। দালাল মন্ত্রী সভার অন্যান্যরা পাহারাদারে পরিবৃত অট্টালিকার কক্ষে চারিদিক বদ্ধ পরিবেশের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। ইহাদের চোখে ভয়, নিঃশ্বাসে ভয়। ঘরের বাহিরে গিয়া পথ চলিবার সাহস হঁহাদের নাই  ইহারা মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত ও আহত-নিহত হইবার আশঙ্কায় এইভাবে দেয়ালঘেরা সতর্কতার মধ্যে এক ধরনের অর্ধ সমাহিত দশা গ্রহণ করিয়াছেন। | যে নিয়তি ইহাদিগকে অনুসন্ধান করিতেছে ও কাছে পাইয়া পরিণাম সম্পূর্ণ করিয়া দিতে চাহিতেছে, তাহাকে ইহারা নিজেরাই আহবান করিয়াছেন। অত্যাচারীর পরিণামের শেষ অঙ্কে এইরূপ দৃশ্যই দেখা যায় ।

ইহা মানবীয় জীবনের ঘটনাতে একটি অভিজাত বাস্তব সত্য। ইহা ঐতিহাসিক সত্য। অত্যাচারী যখন ঘরের বাহিরের আলাে-ছায়াকে ভয় করিতে শুরু করিয়াছে, তখনই বুঝতে হইবে যে, অত্যাচারীর কলুষিত বক্ষের প্রাণ-স্পন্দনের মেয়াদ শেষ হইয়া আসিয়াছে। মহাভারতে এক রাজার কাহিনী আছে। সে রাজার নাম উপরিচর। তিনি মাটিতে হাঁটিতেন না, ভূতল। হইতে উর্ধ্বতর স্তরে বায়ুপথে হাঁটিয়া দূরত্ব অতিক্রম করিতেন। কিন্তু ইহা ভীরু ও আতঙ্কিতের বায়ুপথ যাত্রা ছিল না। প্রজারা হর্ষের সহিত বাহু নিক্ষেপ করিয়া রাজ উপরিচরকে অভিনন্দন করিত। প্রজারা সেই রাজা। উপরিচরকে দেখিতে পাইত । কিন্তু গভর্ণর মালিক সাহেব উপরিচর হইয়া হেলিকপ্টারে যাতায়াত করিলেও তাহাকে এক ধিকৃত গােপন-চর ভীরুর মত যাইতে হইতেছে। বাংলাদেশের ঘটনার মধ্যে অবধারিত পরিণামের একটি সঙ্কেত আজ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আর নাই। দেরী নাই । মুক্তিবাহিনীর জয় পতাকার ছায়া অঞ্চল হইতে অঞ্চলের সবুজ ঘাসের উপর বিপুল এক শুভাবহ মায়ার প্রলেপের মত বিস্তারিত হইতেছে । সুতরাং পাকিস্তানী স্বার্থের হীন জঞ্জালরাশি ওই সব দালাল প্রশাসক ও তাবেদারের ভীরু কলরব নিঃশেষে নীরব হইয়া যাইতে দেরী নাই। দালাল প্রশাসকেরা বাহিরকে ভয় করিয়া ঘরের ভিতরে স্থিরতা অবলম্বন করিয়াছেন, ঘটনার সরল অর্থ এই যে, ভীরু চোর এখন পুকুরের কচুরিপানার ভিতরে লুকাইয়া ও জলের উপর নাক ভাসাইয়া বাঁচিবার নিঃশ্বাসটুকু কোনমতে টানিতেছে। নাই দেরী নাই, গ্রামের মানুষ এইবার ওই পুকুরকে ঘিরিয়া ও শেষ লাঠি চালাইয়া চোরের নিঃশ্বাসের অবসান ঘটাইবে।।

২৩ নভেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!