You dont have javascript enabled! Please enable it! নব যুগের সূচনা - সংগ্রামের নোটবুক

নব যুগের সূচনা

পবিত্র ঈদ উপলক্ষে ইয়াহিয়া খা দরবেশ সাজিয়াছেন । ঈদের বাণীতে ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করিয়া তিনি হাঁক দিয়াছেন— আসুন, আমরা নবযুগের সূচনা করি। অকারণ বিবাদে আমাদের শক্তি এবং সম্পদ অপচয় হইতেছে, সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ হইতে বঞ্চিত হইতেছে। ইত্যাদি আরও নানা সুভাষিতাবলী। একই দিনে দিল্লিকে বিদায় সম্ভাষণ জানাইয়াছেন পাক হাইকমিশনার। জনাৰ সাজ্জাদ হায়দের তুরস্কে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হইয়াছেন। তাহার আসনে দিল্লিতে কে আসিতেছেন পাকিস্তান এখন তাহা মুখ ফুটিয়া বলে নাই। ওদিকে রাওয়াল পিণ্ডিতে মােতায়েন ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রীঅটল ও উপস্থিত দিল্লিতে। আপাতত তাহার নাকি দিন কয়েক দিল্লিতে থাকার মতলব। কিন্তু পিণ্ডি যদি কাহাকেও না-পাঠায়? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হইতেছে দুই দেশের সম্পর্ক বােধহয় এবার সত্যই ‘নবযুগের” দোরগােড়ায়। অন্তত কূটনৈতিক সম্পর্ক ইয়াহিয়া খান নবযুগের ভেরী বাজাইয়াছেন যদিও বন্ধুত্ব যাত্রা করিয়া, কিন্তু আচরণ বলিতেছে কামনা তাহার- বিচ্ছেদ। জনাব সাজ্জাদ হায়দর নাকি ঘােরতর ভারতবিদ্বেষী। সুতরাং ইয়াহিয়া খাঁ তাঁহার সদিচ্ছার প্রমাণ হিসাবে হায়দর সাহেবকে দিল্লি হইতে সরাইয়া লইলেন-আশাবাদীরা হয়তাে অতঃপর এমন যুক্তি আবিষ্কার করিবেন। কিন্তু লক্ষণীয় এই, একা হায়দার সাহেব নহেন, পাক কূটনীতিকরা ফাকে ফাকে দিল্লি ত্যাগ করিতেছেন। অন্যদিকে করাচি এবং পিণ্ডির ভারতীয় দূতাবাসেও ধ্বনি-চলাে দিল্লি। শীতের মুখে ঠিকানা বদলাইবার এই হিড়িক অবশ্যই স্বাভাবিক ব্যাপার নহে। ইসলামাবাদ হইতে ইতিমধ্যে এগারজন ভারতীয় কূটনীতিক সপরিবারে দিল্লি পৌছাইয়াছেন, আরও এগারজন তল্পিতল্পা বাঁধিয়া তৈয়ার। দিল্লি হইতে প্রথম দলে করাচির দিকে উড়িয়াছেন-বারােজন, দ্বিতীয় ব্যাচে আরও পঞ্চান্নজন। বদলি, ছুটি-কৈফিয়ৎ যাহাই হােক, দুই দেশে দুই দেশের দূতাবাসগুলি যে এই মুহূর্তে প্রায় ফাকা সে-বিষয়ে আর সন্দেহ কী! শিবরাত্রির পলিতার মত দূতাবাসগুলিতে যাহারা রহিয়া গেলেন তাহারা নিশ্চয় ইয়াহিয়া খার তথাকথিত নবযুগের প্রতীক নহেন। বরং বলা চলে ভারত আর পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আজ ১৯৬২ সন-পরের চীন- ভারত সম্পর্কের স্তরে। ডাকঘরের মত দুইটি বাড়ি আছে, কিন্তু বাড়িতে পােস্টমাস্টার নাই। আরও লক্ষণীয় ভারত এবং চীন যখন প্রায় এক যুগ পরে রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের কথা ভাবিতেছে তখনই পাক দূত দিল্লি ছাড়িলেন। ‘৬৫ সনের লড়াইয়ের সময়ও কিন্তু এই দৃশ্য দেখা যায় নাই। ‘নবযুগ’ বই কি? 

এই পরিণতি বােধহয় প্রত্যাশিত। লাহােরে ভারতীয় বিমান ধ্বংস হইতে শুরু করিয়া আজ পর্যন্ত যে সব ঘটনা ঘটিয়াছে তাহার পরিপ্রেক্ষিতে শূন্য দূতাবাস মােটেই অবাক কাণ্ড নয়। বিশেষত, কলিকাতা এবং দিল্লির পাক দূতাবাসের অভিজ্ঞতার পর পাকিস্তান যে যথাসম্ভব নিজকে গুটাইয়া লইতে চাহিবে সেটাই। স্বাভাবিক। দিল্লিতে বাঙালী কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক বিদ্রোহের পর পাকিস্তান কয়দিন ধরিয়া দলিল দস্তাবেজ পােড়াইয়াছেন। তখনই বােঝা গিয়াছিল দূতাবাস পরিত্যক্ত না-হইলেও হালকা হওয়ার মুখে। তাছাড়া বাহিরের পরিবেশ এবং পরিস্থিতিও নিশ্চয় বৃহৎ ব্যস্ত দূতাবাসের অনুকূলে নহে। দুই দেশের সেনাবাহিনী। পরস্পরের মুখােমুখি দাঁড়াইয়া । দর্শকেরা সকলে একবাক্য বলিতেছেন- এই উপমহাদেশে নাকি যুদ্ধাবস্থা । পাকবাহিনী এখানে ওখানে সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করিতেছে। পাকিস্তানের অভিযােগ ভারতও নাকি তাহাকে কখনও কখনও আক্রমণ করিতেছে। এই পরিস্থিতিতে কূটনীতিকদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ইঙ্গিতে বলে উত্তেজনা বর্ধমান, আগুন জ্বলিল বলিয়া। কিন্তু ইয়াহিয়া খাঁর মুখে যুগপৎ [ন উদীরণ, ফলে অনেকেই হয়তাে সাময়িকভাবে সংশয়ে আচ্ছন্ন হইবেন। ইয়াহিয়া শরণার্থীদেরও স্বদেশে ফিরিবার জন্য সাদর নিমন্ত্রণ। জানাইয়াছেন। শয়তানও কখনও কখনও শাস্ত্র আওড়ায়, ভূতের মুখে রাম নাম শােনা যায় । ইয়াহিয়ার মুখে এই শান্তিবাণী তাহার পরদেশী পৃষ্ঠ পােষকদের মনােজয়ের জন্য। ইদানীং কোনও একটা ফয়সালার জন্য তাহারা খাঁ সাহেবকে নাকি বড়ই চাপ দিতেছেন। খাঁ সাহেব যদি সত্যই শান্তি চাহিতেন তবে কূটনীতিকদের নয়, তিনি নিশ্চয় সরাইয়া লইতেন তাহার সৈন্যদের।

২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা