You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.02 | অবশেষে চৈতন্যোদয় - সংগ্রামের নোটবুক

অবশেষে চৈতন্যোদয়

কথায় আছে- চোর পালাইলে বুদ্ধি বাড়ে। চোর অনেকবার পালাইয়াছে; কিন্তু লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না আমাদের সরকার বাহাদুরের বুদ্ধি বাড়িয়াছে। অবশেষে তারা নাকি বুঝিতে পারিয়াছেন বিদেশি আগন্তুক। মাত্রেই “গুড় স্যামারিটান” নহেন, শরণার্থী শিবিরে শিবিরে যাহারা হানা দিয়া ফিরিতেছেন তাহাদের মধ্যে। কিছু কিছু ভেজাল থাকাও সম্ভব। পাকা সাত মাস পরে অতএব তাহারা স্থির করিয়াছেন, সীমান্তে অথবা শরণার্থী শিবিরে পর দেশিদের ছাড়পত্র দেওয়ার আগে অতঃপর তাহারা যাচাই করিয়া দেখিবেন। লক্ষণীয়, ইতিমধ্যে সাত সাতটি মাস চলিয়া গিয়াছে। এবং চরেরা হয়তাে তখন খুশিমতাে চলিয়া ফিরিয়াছেন। জিজ্ঞাসা, একই কড়াকড়ি স্বদেশীদের বেলায়ই-বা দেখানাে হইবে না কেন? বিদেশি চর কি সব সময় বিদেশেই জন্মায়? নানা সূত্রে বার বার বলা হইয়াছে শরনার্থী শিবিরগুলিতে শুধু শুধু নির্যাতিত মানবতাই নহে, মতলব বাজেরাও আশ্রয় লইয়াছে।” আসুন বসুন” বলিয়া পিড়িটি আগাইয়া দিবার আগে একটু দেখিয়াশুনিয়া লওয়া দরকার। কিন্তু তাহা যে হয় নাই, শরণার্থী-আস্তানাগুলি হইতে ব্যাপক হারে রেশনকার্ড চুরির ঘটনা তাহা জানাইতেছে। “শরণার্থীরা দেশে ফিরিতেছেন”- এই উপকথাকে মুরুব্বীদের কাছে বিশ্বাস যােগ্য করিয়া তুলিবার জন্য ইয়াহিয়ার চরেরা নাকি সেগুলি সংগ্রহ করিতেছে। রেশনকার্ড নিশ্চয়ই সিঁদ কাটিয়া চুরি করা হইতেছে না। চোর নিশ্চয় নিকটেই আছে। ভুত সরিষার মধ্যে থাকাও অসম্ভব নয়। এই অসতর্কতা এবং অযােগ্যতার নমুনা অন্যত্রও অনেক। দিল্লির পাক হাই-কমিশনে দুই জন পশ্চিম পাকিস্তানী বে-আইনিভাবে আশ্রয় লইয়াছে। ইহাদের একক্লান ছিলেন খুলনায়, আর একজন ঢাকায়। মার্চের বিস্ফোরণের পর বাংলা মুলুক শাসনের সাধ তাহাদের উবিয়া যায়, কোনও মতে প্রাণ লইয়া ভারতে আশ্রয় লইয়াছেন। এ পর্যন্ত দিব্য বােঝা যায়।

কিন্তু পশ্চিম-বাংলার সীমান্ত হইতে তাহারা দিল্লির হাই-কমিশনের হেঁশেলে ঢুকিয়া খিল আঁটিলেন কী করিয়া বােঝা দুঃসাধ্য। এক হিসাব বলিতেছে- এভাবে একুনে দুই শত একান্নব্বই জন পশ্চিম পাকিস্তানী ভারতে প্রবেশ করিয়াছে, ঢাকা-খুলনার খান সাহেবরা সে-দেশে নিঃশব্দে বাংলা হইতে দিল্লি পৌছাইয়া যাইতে পারেন সে-দেশে এই হিসাবকে পাকা হিসাব বলিয়া গ্রহণ করা বােধ হয়। খুব সহজ নয়। দুই শাে আসলে যে দুই হাজার নহে তাহা হলপ করিয়া কে বলিতে পারে? যাহাদের নাম খাতায়। উঠিয়াছে তাহাদের হাল-সাকিন সব জানা আছে তাে? নাকি খোজ লইলে দেখা যাইবে চিড়িয়া কোন্ ফাকে উড়িয়া পালাইয়াছে। আমাদের বাহাদুর প্রহরীদের হাত হইতে এ-জাতীয় ফসকাইয়া যাওয়ার ঘটনা কিন্তু নিতা কম নহে। উদারভাবে কাহাকেও ছাড়িয়া দিবার আগে পাকিস্তানে আটক ভারতীয়দের মুক্তি আদায় করা প্রয়ােজন। সাফ বলিয়া দিতে হইবে একতরফা দাক্ষিণ্যের দিন ফুরাইয়া গিয়াছে, বিনিময় প্রথাই শ্রেয়। ভারত সরকার পাক হাইকমিশনারকে জানাইয়াছেন- আশ্রয় প্রার্থীদের সমর্পণ করিতে হইবে। কিন্তু মনে হয়, তাহারা অন্য কোনও ফিকিরে আছেন। দলিলদস্তাবেজ পােড়ানাে সারা, তল্পিতল্পাও নাকি বাঁধা হইয়া গিয়াছে হয়তাে শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটানােই পাক প্রতিনিধিদের মতলব। তাহার আগে বে-আইনিভাবে ওই বাড়ি হইতে কেহ যেন পালাইতে না পারে সেটা দেখা চাই। মনে রাখা চাই, পালানাে মানেই পশ্চিম পাকিস্তানে পালানাে নহে। আঁকের কই হইয়া এখানে মিশিয়া থাকার চেষ্টাও চলিতে পারে। আগ্রা দেরাদুন বেরেলিতে এক ডজন চর ধরা পড়িয়াছে। ধরা পড়িয়াছে পাঞ্জাবে এবং বিহারেও। পশ্চিম বাংলা আর কাশ্মীর তাে আছেই। পূর্ব-সীমান্তের এপারে নানা স্থানে ব্যাপক অন্তর্ঘাতের চেষ্টাও চলিয়াছে। উদ্যোগ কয়েকটি ক্ষেত্রে রীতিমতাে সফল। অন্তর্ঘাতীরা সকলেই পাকিস্তান হইতে আসিয়াছে এমন মনে করা ভুল। পরদেশীদের এদেশী সহযােগীও নিশ্চয় বিস্তর। সময় বহিয়া যাইতেছে। যুদ্ধের আবহাওয়া বাস্তব। এ সময়ে স্বদেশি বিদেশি পক্ষবাহিনীকে জিয়াইয়া রাখা আত্মঘাতী। অসামরিক প্রতিরক্ষার যতাে মহড়াই আমরা দিই-না কেন, এখনও সতর্ক না হইলে এই চরেরা চোরাবালি জাতির পক্ষে মৃত্যুফাদ হইয়া উঠিতে পারে। পুরাে সাত মাস অতিবাহিত। ভারত সরকার অবশেষে যদি জাগিয়া উঠিলেনই, তবে এবার দেখানাে চাই গৃহস্থের একবার।

২ নভেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা