শরণার্থীদের বােঝা
বাংলাদেশ হইতে আগত শরণার্থীদের চাপ বহন করা ভারত সরকারের পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। ইতিমধ্যে ৯৬ লক্ষ শরণার্থী এ দেশে চলিয়া আসার পরেও শরণার্থীদের আগমন বন্ধ হয় নাই। এখন যাহারা আসিতেছেন, তাহাদের আবার খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে শীতবস্ত্র সরবরাহ করার প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে । ভারত সরকার প্রথমে শরণার্থীদের জন্য ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছিলেন, আগস্ট মাসে অতিরিক্ত বাজেটে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছিল। সম্প্রতি আবার অর্ডিন্যান্সের সাহায্যে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ৭০ কোটি টাকার কর বসানাে হইয়াছে। গত মাসে ৮০ লক্ষ শরণার্থীর প্রয়ােজন হিসাব করিয়া গােটা বৎসরের জন্য মােট ৪১৮ কোটি টাকা লাগিবে বলিয়া ভারত সরকার রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কমিশনকে জানাইয়াছিলেন। তাহার পর আরও ১৬ লক্ষ শরণার্থী বাড়িয়াছে, আগামী দুই-তিন মাসে আরও তিরিশ লক্ষ নূতন শরণার্থী আসা বিচিত্র নয়। | বর্তমান হিসাবে ভারত সরকারকে গােটা বৎসরের জন্য ৪৫০ কোটি টাকার মতাে খরচ করিতে হইবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংস্থা, ইউনিসেফ, রেডক্রস, অন্যান্য দেশের সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন দেশের সরকার নগদ টাকা ও জিনিসপত্রে মাত্র ১৩৮ কোটি টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, কিন্তু সরকারের হাতে আসিয়াছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ শরণার্থীদের জন্য এক সপ্তাহে ব্যয়িত টাকাও সারা বিশ্বের নিকট হইতে ভারত পায় নাই। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভারত সহায়ক সমিতির প্যারিস অধিবেশনে ভারতে আগত শরণার্থীদের জন্য ৩৫০ কোটি টাকা অর্থসাহায্যের কথা বলা হইলেও ১৫০ কোটি টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি মিলিয়াছে। এই টাকার কত অংশ সত্য-সত্যই ভারত পাইবে, তাহা কাহারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। | ভারত দরিদ্র দেশ, তাহা সকলেরই জানা। স্বাধীনতালাভের পর পাকিস্তান হইতে দফায় দফায় শরণার্থী আসিয়াছে, ব্রহ্মদেশ, মালয়েশিয়া, সিংহল, পূর্ব-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ হইতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আসিয়াছে। পৃথিবীর আর-কোন দেশকে, এমন কী জনবহুল চীন দেশকেও এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর দায়িত্ব লইতে হয় নাই। এবারে আগত প্রায় এক কোটির মতাে শরণার্থী ভারতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করিতেছে, শরণার্থীদের পিছনে ব্যয়ের জন্য বিনিয়ােগের টাকা মিলিতেছে না। এত লােকের নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণদ্রেব্য সরবরাহ করা সহজ নয়, সে জন্য সীমান্ত এলাকায় খাদ্যদ্রব্য ছাড়া প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়িয়াছে। ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের দুর্ভোগও যথেষ্ট।
শরণার্থীদের জন্যই বাংলাদেশের সমস্যা আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবে অনেক দেশই গণ্য করিতে রাজী হইতেছে না। প্রতিটি সরকারি বয়ানে শরণার্থীদের উল্লেখ থাকিতেছে, তাহাদের জন্য সভাও নাকি হইতেছে, কিন্তু অর্থ সাহায্য বড়-একটা আসিতেছে না। দুনিয়ার তাবৎ ধনী দেশগুলি শরণার্থীদের ব্যাপারে কার্যত চোখ বুজিয়া আছে। যে দেশ এ ব্যাপারে ভারতে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য করিয়াছে, সে দেশের টাকায় শরণার্থীদের দুই দিনের প্রয়ােজন মিটানােও সম্ভব নয়। দেশ-বিদেশে শরণার্থীদের ব্যাপারে মায়াকান্নার জন্য শরণার্থীদের মনে আশার সঞ্চার হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহারাও আজ নিরাশ। শিবির গুলিতে পাঁচ বৎসরের শিশুগুলির শতকরা পঞ্চাশ জনেরও বেশি অপুষ্টিরােগে ভুগিতেছে। শীতের আবির্ভাবে ইহাদের কয়টি বাঁচিয়া থাকিবে, সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়াছে। শিশুদের সাহায্যের জন্য ইউনিসেফের সৃষ্টি হইলেও ইউনিসেফ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে নাই। শীতকালে শরণার্থী শিবির, মুক্তিফৌজ সকলেরই শীতবস্ত্রের প্রয়ােজন হইবে। বিদেশ হইতে যখন। প্রয়ােজনীয় টাকা আসিতেছে না, তখন শরণার্থীদের জন্য শীতবস্ত্র সাহায্য হিসাবে চাওয়া যাইতে পারে । বিদেশে ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের নিকট অনেক দেশই শরণার্থীদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। ওই সব দেশের সরকার রেডক্রস বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি মাধ্যমেও শরণার্থীদের জন্য শীতবস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করা যাইতে পারে। ব্রিটেনে ৭০ হাজার বাঙালী প্রতি সপ্তাহে মুক্তি-সংগ্রামের জন্য অর্থ সাহায্য করিতেছেন, তাহাদের মাধ্যমেও পােশাকের একটি অংশ সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে মুক্তিবাহিনীর সংসদের জন্য শীতবস্ত্রের আবেদন করা হইলেও শরণার্থীদের জন্য কোন আবেদন জানানাে হয় নাই।
১ নভেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা