কেন এ অপপ্রয়াস
পাকিস্তানের দেখি বন্ধুভাগ্যও ভাল, মুরুব্বী-ভাগ্যও। বাংলাদশে তাহার নৃশংস অত্যাচার গণতন্ত্রী আমেরিকা। কিংবা প্রজাতন্ত্রী চীন দেখিয়াও দেখিতেছে না, বরঞ্চ তাহাকে অস্ত্রশস্ত্র যােগাইয়া যাইতেছে যাহাতে সে বিপাকে না পড়ে। দুনিয়ার ঝানু রাজনীতিক-কূটনীতিকরা তাহার দোষ তাে ধরিতেছেনই না, বরঞ্চ সেটা চাপা দিতেই ব্যস্ত। পাকিস্তান দুনিয়াকে বােঝাইতে চায় বাংলাদেশ বলিয়া কিছু ভারত উপমহাদেশের নাই। যাহারা স্বাধীন বাংলাদেশের ধুয়া তুলিয়াছিল তাহাদের পালের গােদাকে জঙ্গীশাহী জেলে পুরিয়াছে, তাহার “বিচার” ও হইয়া গিয়াছে, যে-কোনও মুহূর্তে তাঁহাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিতে সে পারে, অন্যরা হয় ভুল। বুঝিয়া তােবা ততােবা করিয়া ঘরে ফিরিয়াছে নয় সীমান্তের অপরপারে গিয়া গা-ঢাকা দিয়াছে । জগৎসভায়। ইয়াহিয়া খাঁর বক্তব্য হইতেছে পূর্ব-পাকিস্তানে যেটুকু গােলমাল হইয়াছিল বা হইতেছে সে সবই দুশমন ভারতবর্ষের শয়তানি। | ইয়াহিয়া খাকে মুক্তিফৌজ পাগল বানাইয়া ছাড়িয়াছে। কাজেই তাঁহার মুখ হইতে প্রলাপ যে বাহির হইবে সে অতি আর আশ্চর্য কী? কথায়ই তাে আছে- পাগলে কী না বলে? কিন্তু অবাক কাণ্ড যে বিস্তর কূটনীতিকও তাহার দলে ভিড়িয়াছেন। অন্য পরে কা কথা, জাতিপুঞ্জের জাদরেল সেক্রেটারি জেনারেলও। দেখি জঙ্গী শাহীর ফাদে পা দিয়াছেন। বাংলাদেশের বীভৎস নরহত্যায় তিনি নিজে বিচলিত তাে হন নাই, জাতিপুঞ্জকেও কিছু করিতে দেন নাই। লক্ষ লক্ষ অসহায় নরনারী জঙ্গীশাহীর নির্মম অত্যাচারে প্রাণ। হারাইয়াছেন, অথচ জাতিপুঞ্জ নীরবে সে সব দেখিয়াছে- মানবিক অধিকারের এত বড় অবমাননার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদও জানায় নাই।
বরঞ্চ সেক্রেটারি জেনারেলের পরামর্শে বিপরীতটাই করিতে উদ্যত হইয়াছে, ব্যাপারটাকে ভারত-পাকিস্তানের পুরাতন বিবাদেরই জের বলিয়া তাহার গুরুত্ব নষ্ট করিতে চাহিয়াছে, আসল দোষীকে ছাড়িয়া নিরপরাধ ভারতবর্ষের মাথায় কলঙ্কের পসরা তুলিয়া দিতে প্রয়াস পাইয়াছে। ইসলামাবাদের চোখে অবশ্য নয়াদিল্লির অপরাধ অমার্জনীয়। ভারত শরণার্থীদের আশ্রয় না দিলে তাবৎ বঙ্গসন্তানকে সে উচিত শিক্ষা দিতে পারিত। ভারতবর্ষের ধৃষ্টতার দরুনই তাহার হাতের শিকার ফস্কাইয়া। গিয়াছে। কিন্তু ওয়াশিংটনেরও কী ওই মত? কিংবা জাতিপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেলের? নহিলে ভারতবর্ষ। ও পাকিস্তানকে এক আসনে বসাইবার অপচেষ্টা চলিতেছে কেন? পাকিস্তানের অমিত্র না হইলেও রাশিয়া স্বীকার করিয়াছে এ ব্যাপারে পাকিস্তান ও ভারতবর্ষকে তূল্যমূল্য করা সত্যের বিকৃতি, ন্যায়ের ব্যভিচার। ‘প্রাভদা’ ঠিকই বলিয়াছে ভারতবর্ষের আচরণ ও নীতি সমালােচনার উর্ধ্বে তাে বটেই, অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নিজের সীমিত সঙ্গতি লইয়া সে নিপীড়িত গৃহহারা প্রায় এক কোটি লােককে আশ্রয় দিয়াছে। আর যাহাই হউক, পাকিস্তানের সঙ্গে এ ব্যাপারে ভারতবর্ষের কোনও তুলনাই চলিতে পারে না। বাংলাদেশে আজ যে ত্রাসের রাজত্ব চলিতেছে সে সৃষ্টি করিয়াছে জঙ্গীশাহীর পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতার উপর দুর্জয় লােভ, গণতন্ত্রের উপর প্রবল অবজ্ঞা। তাহার চেষ্টা ওই নির্মম সত্যকে তামাম দুনিয়ার নিকট হইতে লুকাইয়া রাখা। সে অপপ্রয়াস সফল হয়, যদি বাংলাদেশ- নাটকে খল নায়কের ভূমিকায় ভারতবর্ষকে নামানাে যায়। উ থান্ট সে অপপ্রয়াসকে সার্থক করার ব্যবস্থাই করিতেছেন বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে ভারত পাকিস্তান মনােমালিন্যের সঙ্গে যুক্ত করিয়া। বাংলাদেশে নরকের আগুন জ্বালাইয়াছে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকার। তাহাতে একটা কুটা দিয়াও ইন্ধন যােগায় নাই ভারতবর্ষ। তবে তাহার মুখে কালি মাখাইবার এ দুষ্প্রবৃত্তি উ থান্টের কেন হইল? ভারতবর্ষের তাহাতে বিশেষ কিছু আসিয়া-যাইবে না-এ সত্য অনেকেই জানে, কাজেই বিভ্রান্ত বিশেষ কেহ হইবে না। কিন্তু যে মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই জাতিপুঞ্জের লক্ষ্য, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নির্লজ্জ আক্রমণ হইতে তাহাকে বাচাইবার কোনও দায়িত্ব কি সেক্রেটারি-জেনারেল উ থান্টের নাই।
২৬ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা