You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.30 | ভারত প্রস্তুত এবং নিঃসঙ্গ নহে - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত প্রস্তুত,এবং নিঃসঙ্গ নহে

প্রথমেই যে রিপাের্টই বাহির হইয়া থাকুক না কেন, সােভিয়েত উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পর যে যৌথ বিবৃতি বাহির হইয়াছে তাহা পড়িয়া সন্দেহের অবকাশ মাত্র থাকে না যে, শ্রী ফেরুবিন নিতান্ত সাং-বৎসরিক রীতি রক্ষা করিতে এবার এদেশে আসেন নাই। তাহার আগমনের তাৎপর্য আরও গভীর ছিল। সােভিয়েতভারত চুক্তির কার্যকরী ধারাগুলি, মনে হয়, বৈঠকে ভালভাবেই আলােচিত হইয়াছে। – এবং এই চুক্তি শুধুই তাে শান্তির নহে, সহযােগিতারও। লক্ষ্য শান্তি, কিন্তু উপরটা সহযােগিতা। এক কথায়, বাহিরের লক্ষণ দেখিয়া অনুমান হয়, সন্ধিপত্রটা কাগজে বাঘ নাও হইতে পারে, ইহার দাঁতও আছে। অন্তত আছে যে, সেটা ইয়াহিয়া খানদের সমঝাইয়া দেওয়া দরকার। শ্রী ফেরুবিন আসিয়াছিলেন এক সন্ধিক্ষণে। তাহার পরে-পরেই আসিয়াছেন সােভিয়েত বিমানবাহিনীর . সর্বাধ্যক্ষ এয়ারমার্শাল কুটাখত। আর-কিছু না হইলেও এই আসা যাওয়া এই উপমহাদেশের ব্যাপারে সােভিয়েত আগ্রহের প্রমাণ। শ্রী ফেরুবিন যদি ভারতকে কেবলই বুঝাইয়া- পড়াইয়া নিরস্ত্র রাখার জন্যই আসিতেন, তাহা হইলে বিমান বাহিনীর সেনানীর পদার্পণের কোনও কারণ থাকিত না। এক একে মিলিয়া দুই, অথবা দুইয়ে দুইয়ে মিলিয়া যােগফলটা চার বলিয়াই ঠেকিতেছে। শ্রী ফেরুবিন যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্ভাবনার আন্দাজ লইয়া ফিরিয়া গিয়া থাকেন, তবে এয়ারমার্শাল কুটাখত প্রতিরক্ষা পরিস্থিতির আন্দাজ লইয়া ফিরিবেন নিশ্চয় । আশা-ইহা এই মুহূর্তে একান্তই আশার বিরুদ্ধে আশা-সােভিয়েত-ভারত মৈত্রীর গুরুত্ব ইসলামাবাদের চৈতন্যে কিঞ্চিৎ সাড়া জাগাইতেও পারে। শ্রীমতী। গান্ধী বাহিরের জগতে শাস্তি-মিশনে বাহির হইয়াছেন। সেই সঙ্গে এই কথাও স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের আজ দোসর আছে, সে নিঃসঙ্গ বা একা নয়।  তার মানে এই নয় যে আজিকালি আরম্ভ হইবে মহারণ।

যুদ্ধ, না শান্তি? প্রধানমন্ত্রী বলিয়ছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর পাকিস্তানেরই জানা আছে, এই প্রশ্নের উত্তর পাকিস্তানের কাছে। দেশবাসীকে তিনি সজাগ। থাকার আহ্বান জানাইয়া বিদেশ যাত্রা করিয়াছেন। দেশ ঘুমাইয়া আছে, এ কথা এখন আর বলা চলেনা। সীমান্তে জওয়ানেরা সতর্ক প্রহরায়। মন্ত্রিসভার বিশেষ কমিটির ঘন ঘন বৈঠক বসিতেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানাইয়াছেন, সীমান্তে এখনও প্রভূত উত্তেজনা। পশ্চিম সীমান্তে পরিস্থিতি যদি আগ্নেয়, পূর্বে তবে মাঝে মাঝে সশব্দ বিস্ফোরণের আওয়াজও শােনা যায়। পাক গােলাবাজি ও নাশকতা অব্যাহত। সীমান্তের এ দিকেও অসামরিক প্রতিরক্ষার তােড়জোড় চলিতেছে, তাহার ঢেউ লাগিয়াছে কলিকাতাতেও। তবু যাহাকে বলে “যুদ্ধ-জ্বর”, তাহা ভারতকে পাইয়া বসে নাই । আঘাতের পর আঘাতে প্ররােচনার পর প্ররােচনায় খালি তাপ বাড়িতেছে। নহিলে, এক অর্থে ঘুসঘুসে জ্বরতে লাগিয়াই আছে গত সাত মাস ধরিয়া । এই দীর্ঘ সময়ে পিণ্ডি যে কেবল বাংলাদেশ-সমস্যার সমাধান করিতে অস্বীকার করিয়াছে তাহা নহে,  হঠকারী জঙ্গীচক্র এখন নূতন নূতন সমস্যা সৃষ্টি করার ফিকির খুঁজিতেছে। শরণার্থী-স্রোত আজও অবিরাম।

নির্বাচনে বাতিল তাবেদারদের লইয়া খাঁ সাহেব বিশ্বস্ত তাবু খাটানাের তালে আছেন। ওদিকে কূটনৈতিক চাল অর্থাৎ রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপ, উ থান্টকে নিমন্ত্রণ যখন চলিয়াছে, তখন বিদেশি পর্যবেক্ষকরাই বলিতেছেন, কী পূর্বে, কী পশ্চিমে পাকিস্তান লড়াইয়ের জন্য তৈয়ার। বারুদ কৰে জ্বলিবে কেহ জানে না, তবে ইহা ঠিক যে, জ্বলিলে সেটা জ্বালাইবে পিণ্ডির জঙ্গীশাহীই। জ্বালাইবে কেন, সে কথা ব্যাখ্যা করিয়া বলার দরকার নাই। সর্দার স্বর্ণ সিং এবং শ্রী ডি,পি ধর উভয়েরই বক্তব্য আসল কারণ মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তা। ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধানও একই সতর্কবাণী শােনাইয়াছেন। আসল কথা মরীয়া পাক বাহিনী ক্রমে আরও বেপরােয়া হইয়া উঠিবে। পিন্ডি যদি তথাকথিত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ঘটাইতে বিফল হয়, তবে লড়াই ছাড়া তাহার সামনে দ্বিতীয় রাস্তা খােলা নাই। তাহার আশা আর হিসাব এই যে, লড়াইয়ে একবার যদি ভারতকে জড়াইয়া ফেলা যায়, তবে দুনিয়ার মুরুব্বীরা হা-হা করিয়া ছুটিয়া আসিবে, শেষ পর্যন্ত খাঁ সাহেবের মুখরক্ষা হইবে। যুদ্ধ ভারত চাহে না, কিন্তু যুদ্ধের জন্য সে প্রস্তুত। এও এক ধরনের ধর্মযুদ্ধই হইবে, এবং সেই যুদ্ধের নৈতিকতা প্রশ্নাতীত। ৯০ লক্ষ নাগরিকের দায়িত্ব গ্রহণ এবং তাহার বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার মুখে দেশকে ঠেলিয়া দেওয়ার বদলে দ্বিতীয় পন্থা নানাদিক হইতেই অর্থপূর্ণ। বাঞ্ছনীয় না হইলেও প্রয়ােজনীয়। লুপ্ত হওয়ার বদলে একটা নবীন জাতি বাচিয়া যাইবে। সম্ভাবনা এখন অবধি ভারতের পক্ষেই অনুকূল। প্রথমত রাশিয়া ভারতের পাশে দাঁড়াইবে বলিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং দ্বিতীয়ত, কী চীন, কী আমেরিকা দূর হইতে যতই মদত জোগাক, শেষ পর্যন্ত পিণ্ডির হইয়া বাদাম তুলিয়া আনিতে উনুনে হাত বাড়াইবে বলিয়া মনে হয় না- শ্রীস্বর্ণ সিংয়েরও ধারণা তাহাই।

৩০ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা