প্রধানমন্ত্রীর সাফ কথা
বিদেশ যাত্রার আগে প্রধানমন্ত্রী তাহার সাংবাদিক সম্মেলনে কিছু সাফ কথা শুনাইয়া গেলেন। কোনটিই হয়তাে নতুন কথা নয়, তবু নতুন করিয়া উচ্চারণের প্রয়ােজন ছিল। কারণ, ইতিমধ্যে শুধু যে ইয়াহিয়া খা অন্য সুরে গাহিতে শুরু করিয়াছেন তাহা নহে, শােনা যায় তাহার নাকী-সুর কাহারও কাহারও মরমেও নাকি পশিয়াছে। মােড়লেরা আবার ভারত আর পাকিস্তানকে সমদৃষ্টিতে বিচারে উদ্যোগী হইয়াছেন, দুইয়ের উপরই নাকি সমান চাপ-সীমান্তে উত্তেজনা হ্রাস করা চাই। প্রধানমন্ত্রীর সাফ উত্তর-ভারত সৈন্য সরাইবে না। যুদ্ধ, শান্তি-সে প্রশ্নের উত্তর জানেন ইয়াহিয়া খাঁ, ভারত আত্মরক্ষায় বদ্ধপরিকর। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কয়দিন আগে খােলাখুলিই বলিয়া দিয়াছেন-যতদিন বাংলাদেশ সমস্যার ফয়সলা না-হইতেছে ততদিন সীমান্তে ভারতীয় ফৌজও আছে। ইন্দিরাজীর পূনরুক্তি জানাইল-এ ব্যাপারে ভারতের উপর কোনও চাপে। কাজ হইবে না। প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় না’ একই শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি। তিনি জানাইয়াছেন-ইয়াহিয়া খা আজ ভারতের। সঙ্গে বৈঠকের জন্য যত ব্যাকুলতাই প্রকাশ করুন না কেন, তাহাতে ভারতের সাড়া মিলিবে না। কারণ-বাংলাদেশ ভারতের সমস্যা নয়, সে সমস্যা পাকিস্তানের। বৈঠক যদি কাহারও সঙ্গে করিতেই হয়। তবে করিতে হইবে সেখানকার গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে। ডাঃ মালিকের মতাে পুতুলদের সঙ্গে নয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে। ইয়াহিয়া খীর মতলব একদিকে অসামরিক শাসনের নামে বাংলাদেশে এক তাঁবেদার। সরকার প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে দুনিয়ার দৃষ্টিকে বাংলাদেশ হইতে সরাইয়া আনিয়া ভারত-পাকিস্তান বিবাদে পরিণত করা। একদিকে রণসজ্জা, অন্য দিকে বৈঠকের জন্য মায়াকান্না সে-বাসনায়ই।
অস্বীকার করার উপায় নাই, পাকিস্তানের এই চাল অংশত সফল, সীমান্তে উত্তেজনা দেখিয়া আজ অনেকেই নাকি বিচলিত। ইন্দিরাজী জানাইয়া দিলেন-ভারত কিছুতেই এই ফাদে পা দিতেছে না। মধ্যস্থতা-ইত্যাদির প্রস্তাবও সম্পূর্ণ অবান্তর। তাহার নিজের ঘর সামলাইবার দায় পাকিস্তানের; ভারতের মাথাব্যথা প্রধানত শরণার্থীদের লইয়াই । সম্ভাব্য মধ্যস্থরা এবার কী করেন, সেটাই দেখিবার। প্রধানমন্ত্রী তৃতীয়বার ‘না’ উচ্চারণ করিয়াছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতি। সীমান্তে রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষক। পাঠাইবার প্রস্তাব তিনি সরাসরি নাকচ করিয়া দিয়াছেন। তথাকথিত এই পর্যবেক্ষক চিন্তা এক গভীর। ষড়যন্ত্রের ফল। ইহারা কী পর্যবেক্ষণ করিবেন? শরণার্থী শিবির ছাড়া ভারত তাহাদের আর কিছুই দেখাইতে বাধ্য নয়। সেখানে তাে তাঁহাদের আনাগােনা লাগিয়াই আছে। পৃথিবীর সর্ব দেশের মানুষ স্বচক্ষে তাহাদের অবস্থা দেখিয়া গিয়াছেন। তাহার পরও যখন পর্যবেক্ষক মােতায়েনের কথা ওঠে তখন বুঝিতে অসুবিধা নাই জল ঘােলা করাই পাক-বান্ধবদের মতলব। প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন—তাহারা বরং সীমান্তের ওপারে বসিয়াই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করুন লক্ষণীয় ব্যাপার এই, এক সময় যাহা ছিল ইয়াহিয়া খাঁর ‘ঘরােয়া ব্যাপার এখন তাহার নিষ্পত্তির জন্য ইয়াহিয়া খা শুধু যে যে কোনও জায়গায় যে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করিতে প্রস্তুত তাহা নহে, তিনি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্যও কাঁদিয়া আকুল। ইয়াহিয়া খাঁ নিমজ্জমান ব্যক্তির এক যথার্থ প্রতিচ্ছবি।
প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন-তঁহাকে ভাসাইয়া রাখার জন্য যে আন্তর্জাতিক চেষ্টাই চলুক, ভারত অনড়। থাকিবে। এ দেশের সহানুভূতি কোন দিকে সে কথাও তিনি গােপন রাখেন নাই। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে এখনও তিনি কোনও পাকা তারিখ বা পাকা কথা দেন নাই বটে, তবে মুক্তিযােদ্ধাদের। জয় যে অনিবার্য দেশবাসীকে সেই আশার বাণী শুনাইয়াছেন। ইয়াহিয়া খা তাে বটেই, অন্যরাও জানেন-মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রকাণ্ড ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু আন্তর্জাতিক দুনিয়া, বিশেষত সরকারী দুনিয়া এই যুদ্ধ সম্পর্কে আশ্চর্যভাবে মেীন। শােনা যায় মার্শাল টিটো নাকি এই যুদ্ধের সংগ্রামীদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছেন। ভারতের সমর্থন আরও প্রকাশ্য হইলে ক্রমে অন্যরাও হয়তাে রাজনৈতিক মীমাংসায় এই লড়াইয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে পারিবেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখে মুক্তিযুদ্ধের এই জয়গান সেদিক হইতে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। কথা এই,-যুদ্ধ, না শান্তি প্রধানমন্ত্রী তাহার উত্তর দেন নাই। বলা নিষ্প্রয়ােজন, যুদ্ধের অনুপস্থিতিই। শান্তি নয়। নব্বই লক্ষ শরণার্থীর সমস্যা রহিয়াছে এবং সেই সঙ্গে রহিয়াছে বাংলাদেশ সমস্যার-রাজনৈতিক। মীমাংসার’র প্রশ্ন। একের সঙ্গে অন্য ওতপ্রােতভাবে জড়িত।-মীমাংসার তবে পথ কী? ইয়াহিয়া খাঁর সামনে আর কোনও পথ খােলা নাই, অতএব তিনি যুদ্ধের পথে পা-বাড়াইয়াছেন। যে-কোনও মুহূর্তে তিনি ঝাপ দিতে পারেন। তাহা হইলে ভারতকেও সাড়া দিতে হইবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও কারণে পিন্ডির জঙ্গীচক্র যদি যুদ্ধের সুযােগ হইতে বঞ্চিত হয়-তবে? বাংলাদেশ সমস্যা নিশ্চয় চিরকাল নিশ্চল থাকিবে না। শেষ ভরসা কী তবে মুক্তিযােদ্ধারাই?
২১ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা