অন্তঘাত বন্ধ করা চাই
কাছাড় কী ভারতের সীমানার বাহিরে? কাছাড় কী কোনও বেওয়ারিশ মুলুক? অথচ রকম সকম এমন যে। বাহিরের লােকের মনে হইতে পারে কাছাড়ও বুঝি ইয়াহিয়া খাঁর তালুক। খান সাহেবের দখলীকৃত এলাকায় যেমন নিত্য অন্তর্ঘাত ঠিক তেমনই কাছাড়ে। বাংলাদেশের ভিতরে কী চলিতেছে আর কেনই বা বাঙালী তরুণদের এই মরণপণ অভিযান বিশ্ব সুদ্ধ মানুষ তাহা জানেন। কিন্তু কাছাড়ের ঘটনাবলী, অস্বীকার করার উপায় নাই, রীতিমত রহস্যময়। কেননা, কাছাড় ভারতের অন্তর্গত এবং একের পর এক অন্তর্ঘাতের ঘটনা। বলিতেছে যে, আসামের ওই এলাকাটি হয় দেশ দ্রোহীদের মরুদ্যান, না হয় সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার মতাে কেহ নাই। তাহা ছাড়া এই হঠকারিতার ব্যাখ্যা কী? গত দুই মাসে এক কাছাড়েই অন্তর্ঘাতের ঘটনা সাতটি। তাহার মধ্যে সফল-একাধিক। গত আগস্টে একটি রেল-অ্যাম্বুল্যান্স সমেত একটি মালগাড়িকে ঘায়েল করা হইয়াছে। তাহার পরও চোরাই হানাদারির। বিরাম নাই । শনিবার করিমগঞ্জ ধর্মনগর শাখায় রেলপথে মাইন এবং প্ল্যাস্টিক বােমা পাওয়া গিয়াছে। রবিবার। বিকালে গৌহাটি-আলিপুর শাখায় একটি মালগাড়ি লাইনচ্যুত। আগের দিন কাছাড়ের বদরপুর-করিমগঞ্জ শাখায় যাহা ঘটিয়াছে তাহা আরও গুরুতর। ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন-এর মুখে চারিটি মালগাড়ি উড়িয়া গিয়াছে; রেলপথ বিপর্যস্ত। চরদের কুশলতায় আসামের সঙ্গে অবশিষ্ট দেশের রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম। ঘটনার পরে যথারীতি তদন্ত চলিয়াছে, সন্দেহভাজন কয়েকজনকে নাকি ধরাও হইয়াছে। তাহারা কাহারা? আগে একবার সংবাদ পাওয়া গিয়াছিল অন্তর্ঘাতের দায়ে যাহারা ধরা পড়িয়াছে তাহারা নাকি ভারতেরই নাগরিক। এবারও কী একই পরিচয় তাহাদের দেশবাসী জানিতে চাহেন-ইহারা ইয়াহিয়ার চর না। পরদেশী অনুচর? মাইন যখন ফাটে সীমান্তের ওপার হইতে পাকিস্তানী ফৌজ নাকি তখন গােলাবর্ষণ শুরু করে। যােগাযােগ কাকতালীয় না-হওয়ারই সম্ভাবনা। এই সব ঘটনার পিছনে পাকিস্তানী হাত স্পষ্ট। পাকিস্তানী। জঙ্গীচক্র এজন্য ভারতে হাজার হাজার শিক্ষিত চর পাঠাইয়াছে -এ সংবাদও নানা সূত্রে সমর্থিত। ইতিমধ্যে এক পশ্চিম বাংলায়ই নাকি এক হাজার চর ধরা পড়িয়াছে।
কত কই ঝাকে মিশিয়া আছে দেশে অন্তর্ঘাতের জন্য হানাদার, প্রেরণ কিংবা চর প্রেরণে যে-সব অসুবিধা থাকে এখানে তুলনায় তাহা খুবই সামান্য। উদ্বাস্তু স্রোত অব্যাহত শত্রু তাহাদের ভিড়ে মিশিয়া ও অনুপ্রবেশ করিতে পারে। দ্বিতীয়, এখানে আশ্রয়দাতারও অভাব না-হওয়ারই কথা। দেশের মানুষ যখন শরণার্থীদের জন্য ব্যাকুল, কেহ কেহ তখন অবশ্যই ব্যাকুল ইয়াহিয়ার জন্য। কাছাড় কী আজ তাহাদেরই চারণভূমিতে পরিণত ( সন্দেহ স্বাভাবিক। কারণ, নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সত্বেও অন্তর্ঘাতের ঘটনা সেখানে ঘটিয়াই। চলিয়াছে। ইতিপূর্বে পাইকারি জরিমানার মতাে কোন ব্যাপক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের কথাও শােনা গিয়াছে। কিন্তু তাহাতে কাজ যে বিশেষ কিছু হয় নাই তাহা স্পষ্ট। অথচ শুধু যােগাযােগ অব্যাহত রাখার। জন্য নহে অন্য কারণেও আসামের ওই অঞ্চলটিকে আজ সম্পূর্ণ নিরাপদ করা প্রয়ােজন। ইয়াহিয়া পশ্চিম এবং পূর্ব দুই সীমান্তেই ব্যাপক রণসজ্জা করিয়াছে। যুদ্ধ ঘােষিত হােক বা না-হােক, পূর্ব সীমান্ত বরাবর। অঘােষিত এক ধরনের যুদ্ধ গত কয় মাস ধরিয়াই চলিয়াছে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক আক্রমণও তীব্রতর হওয়ারই সম্ভাবনা। এ সময়ে সমগ্র দেশ যখন শত্রুর মােকাবিলায় প্রস্তুত, এখানে ওখানে তখন পঞ্চম বাহিনীর পকেট জিয়াইয়া রাখা আদৌ সঙ্গত নয়। রীতিমত নির্বুদ্ধিতা। অন্তর্ঘাত-ইয়াহিয়ার আন্তরিক কর্মসূচীর একটি এটা তাহার দোসরা রণাঙ্গণ। সে চাহিবে অন্তর্ঘাতের এলাকা ক্রমেই প্রসারিত করিতে। পুনায় যে সামরিক ট্রেনটি অল্পের জন্য বাচিয়া গিয়াছে সেটি ইয়াহিয়ার চরদের। কাজ না-ও হইতে পারে,-আবার হইতেও পারে। পাকিস্তানী চর শুধু রেলপথেই নিজেদের দৃষ্টিকে আবদ্ধ রাখিবে, তাহা মনে করাও ভুল। যে-কোনও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বিভ্রাট সৃষ্টিই হইবে তাহাদের লক্ষ্য। দেশে। যুদ্ধাবস্থার সুযােগে যাহারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিবে পরােক্ষে তাহারা এসময়ে খান সাহেবের সেবাদাসেরই কাজ। করিবে। সকলের জন্য এক ব্যবস্থা হয়তাে এই মুহূর্তে সম্ভব নয় কিন্তু ইয়াহিয়া খাঁর ভাড়াটিয়া চর আর তাহাদের পৃষ্ঠপোষক অনুচরদের শায়েস্তা করা এক জরুরী জাতীয় কর্তব্য। চর-জমি তথা চোরাবালির বিপদের কথা তারস্বরে জানাইয়া চলিয়াছে কাছাড়, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব যাহাদের তাহাদের এবার জানাইতে হইবে-কাছাড় পুরাপুরি শত্রুমুক্ত। সে শক্রর মাথায় যাহারই টুপি থাকুক। নয়ত অতঃপর লােকে ভাবিবে ভূত কী তবে সরিষাতেই।
২০ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা