You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের আর এক মতলব

পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করিতে পারে, এটা আজ আর অলীক কল্পনা মাত্র নয়, রীতমত দৃষ্টিগ্রাহ্য সম্ভাবনা। সীমান্তের এপারে দাঁড়াইলে নাকি পাকিস্তান বাহিনীর প্রস্তুতি চোখে দেখা যায়, শতদ্রুর দক্ষিণ তীরে ব্যস্ততার অন্ত নাই। এদিকে পূর্ব সীমান্তের গেদে, শিকারপুর, রুরা ও ডাংয়েও গুলিবিনিময় হইয়াছে। পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানী তৎপরতা অবশ্য নূতন নয়। কিন্তু পশ্চিমে তাহাদের গতিবিধি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। হইতে পারে পাকিস্তান ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে পশ্চিম সীমান্তে আটক রাখিতে চায়, পূর্ব সীমান্তে তাহা হইলে  জঙ্গীতন্ত্রের কিঞ্চিৎ সুবিধা। কিন্তু এটা নিছক রণকৌশলের ব্যাপার নাও হইতে পারে। পশ্চিম সীমান্তে এই ব্যাপক সমরসজ্জার পিছনে কূট রাজনৈতিক- সামরিক মতলব থাকাও সম্ভব। ভূতপূর্ব পাক-কূটনীতিক শ্রী হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর মতে পাকিস্তানের মতলব অবশিষ্ট কাশ্মীর গ্রাস করা। কারণ, বাংলাদেশ প্রায় হাতছাড়া। সে ক্ষতি নাকি একমাত্র কাশ্মীরই পূরণ করিতে পারে। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানীদের বুঝাইতে পারিবেন- নাক গিয়াছে, কিন্তু এই দেখ, নরুন পাইয়াছি। কাশ্মীরের তথাকথিত বেহেস্তের লােভে রাওয়ালপিণ্ডির বাদশারা যদি শারদীয় অভিযানে বাহির হন তবে সেটা মােটেই বিস্ময়কর কোনও কাণ্ড হইবে না। কাশ্মীরের জন্য পাকিস্তানের খােয়াব জন্মাবধি। সামরিক অভিযানে একবার কাশ্মীরের এক ফালি মিলিয়াছে। বাকিটুকু রাজনৈতিক কৌশলে আদায় হইবে তাহা আর আশা করা যায় না। একদা যাহারা কাশ্মীরীদের “আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারের” নামে পাকিস্তানকে মদত দেখাইয়াছেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলির পর আজ তাঁহারা নিশ্চয়ই আর খােলাখুলি তাহা করিতে পারিবেন না। বিলাতের একটি কাগজ সরাসরিই লিখিয়াছে- কাশ্মীর প্রশ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মতই আজ মৃত। অথচ বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল তখনও যদি পশ্চিম-পাকিস্তানীদের হাতে কাশ্মীর তুলিয়া ‘ দেওয়া না যায়, তবে এই শােকে সান্ত্বনা কোথায় মিলিবে। উপনিবেশ হিসাবে কাশ্মীর উপত্যকা সুজলা সুফলা বাংলার উপযুক্ত বিকল্প কিনা সে-সব অন্য কথা। ‘৬৫ সনের যুদ্ধে বাংলার মানুষ জানিয়াছে— পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী কাশ্মীরের জন্য যতখানি লােভাতুর বাংলার জন্য ততখানি নহে।

ওয়াকিবহালরা জানেন-বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের পিছনে এই কাশ্মীরের ভূমিকা অনেকখানি। পাকিস্তানী রাজনীতি-সমরনীতি এবং তাহার জের হিসাবে অর্থনীতি-সবই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করিয়া । সেই কাশ্মীর মৃত্যুশয্যায়ও পাকিস্তানের সাধ থাকিয়া যাইবে, এটাই স্বাভাবিক। যথার্থ বলিতে কি, ইয়াহিয়া খাঁর কাছে কাশ্মীর আজ নিমজ্জমান ব্যক্তির কাছে কুটোর মত। যদি মেলে, অনেক সুবিধা,- দৈর্ঘ্যে প্রস্থে হইবে সমান টানা। ভূগােলের মত ভাষা ইত্যাদির দূরত্বও ঘােচে। সুতরাং, এতদিন ধরিয়া দেশে বিদেশে সকলে যে যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা বলিয়া আসিতেছেন তাহা এই মুহূর্তে রীতিমত সমূহ সম্ভাবনা। লক্ষনীয় ব্যাপার এই, আর সকলে যখন ভাবিয়াছেন শরণার্থী প্রশ্নে ভারতই হয়তাে সামরিক ব্যবস্থা লইতে বাধ্য হইবে, তখন কিন্তু পাকিস্তানই “মুক্তির” সন্ধানে যুদ্ধের পথে পা বাড়াইতে চলিল। অথচ এই উপমহাদেশের মঙ্গল চিন্তায় ব্যাকুল শুভার্থীরা এখনও ভারত-পাকিস্তান শব্দ দুইটি একই সঙ্গে উচ্চারণ করিতেছেন। নিউইয়র্ক হইতে ফিরিয়া শ্রী স্বর্ণ সিং সান্ত্বনা দিয়াছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য অনেকেই অনুমােদন করে। সিমলা বক্তৃতায় শ্রীস্বর্ণ সিং পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়াছেন, সময় বহিয়া যাইতেছে। মার্কিন সেনেটর বিশেষ কমিটি পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করিতে বলিয়াছেন, বিলাতের লেবার পার্টিরও দাবি ইহাই।

শােনা যায় পাক-বান্ধব সমিতির পাকিস্তানকে অর্থসাহায্য মঞ্জুর না করারই সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাইতেছে- পাকিস্তান নিজ সংকল্পে অটল। এই একগুঁয়েমি কি নিছক নির্বোধের আহাম্মুকি? না কি, পিছনে অন্যেদেরও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রহিয়াছে? একমাত্র দেখা যাইতেছে শুধু রাশিয়াই ইয়াহিয়া খানের সমালােচক। এবং সে সমালােচনা ক্রমেই স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। পাক-সরকারি মুখপাত্র কোসিগিনের সরাসরি সমালােচনা করিতেছেন। সেটা কি ঢাকাস্থ চীনা প্রতিনিধিদের বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতির নজরানা? না কি, ওয়াশিংটনের মনােজয়ের আর এক দফা আন্তরিক চেষ্টা? তবে এটা বােঝা যাইতেছে। তাসখন্দের প্রখ্যাত মধ্যস্থ রাশিয়া পরবর্তীকালে যেভাবে পাকিস্তানের দিকে ক্রমেই ঝুঁকিতেছিল তাহাতে শুধু যতি নয়, সম্ভবত বিরতি টানা হইয়াছে। গােটা রাশিয়ায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানাে হইতেছে, তবে রাশিয়া বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে এখনও-স্বাগত জানায় নাই। রাওয়াল পিণ্ডির জন্য রুশহৃদয়ে যেটুকু জায়গা আলাদা করিয়া রাখা হইয়াছিল, মনে হয় এবার সেখান হইতেও “সংরক্ষিত” লেবেলটি তুলিয়া পকেটে রাখা হইয়াছে। ভারতের পক্ষে এটা অবশ্যই আশ্বাসের কথা, কারণ “শ্যাম রাখি কুল রাখি” নীতি নির্ভরতার ঝুঁকি সব সময়েই থাকে। তবে বলাবাহুল্য রাশিয়ার এই নূতন নীতির চূড়ান্ত   পরীক্ষা এখনও বাকি। সে পরীক্ষা কোথায় হইবে, বাংলাদেশে না কাশ্মীরে সেটা হয়তাে এই মুহূর্তে বলা শক্ত। যুগপৎ দুই জায়গায়ই সম্ভব। কাশ্মীর উপলক্ষে রাশিয়া ইতিপূর্বে একাধিকবার জানাইয়াছে সে-কোথায়; রুশ-ভারত চুক্তির পরে এবার দুই রণাঙ্গনে তাহার বিশেষ কী ভূমিকা হয় সেটাই দেখিবার । বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তাহার মনােভাবও কিন্তু এখনও অস্পষ্ট।

১১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!