ইয়াহিয়া খানের রণসজ্জা
সীমান্তের ওপারে পাকিস্তান ব্যাপক সমরসজ্জা করিয়া চলিয়াছে। তিনশ’ বিয়াল্লিশ মাইলব্যাপী পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানী বাহিনীর প্রস্তুতি নাকি প্রায় সম্পূর্ণ। জম্মু কাশ্মীর হইতে কচ্ছের রান-কোনও এলাকা বাদ নাই। কোথায়ও কাফু জারি করা হইয়াছে, কোথায়ও মাইন পাতা হইয়াছে, কোথায়ও খাদ কাটা হইতেছে। পূর্ব সীমান্তেও একই সংবাদ। বর্ষা শেষ হইতে না হইতে সীমান্তের ওপারে সাজ সাজ রব পড়িয়া গিয়াছে। গােলাগুলি বিনিময় এই কয়মাস ধরিয়াই চলিয়াছে। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা পাকিস্তান এবার বড় রকমের কোনও লড়াইয়ে মাতিবে; ইয়াহিয়া খান যাহাকে বলিয়াছেন ‘টোটাল ওয়ার’- সার্বিক মতেই। প্রশ্ন উঠিতে পারেএই লড়াইয়ে পাকিস্তানের হিম্মত কতখানি অবশিষ্ট আছে। বিশেষত, বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নামিবার পর শুধু পাক-সামরিক বাহিনী নহে, পাকিস্তানী অর্থনীতি রাষ্ট্রিক কাঠামাে সবই যখন ক্ষতবিক্ষত সম্ভবত এই বিবরণের মধ্যেই পাকিস্তানের রণতৃষ্ণার কৈফিয়ৎ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। দিশেহারা পাজঙ্গী তন্ত্রের সামনে যুদ্ধ ছাড়া আর কোন পথ খােলা আছে? পরিস্থিতি যখন এমন মারাত্মক ছিল ন তখনও পাকশাসকগােষ্ঠীর প্রাণবায়ু ছিল ভারত বিরােধী জিগির। স্বদেশের ক্ষুব্ধ বঞ্চিত মানুষকে এছাড়া তাহাদের দেয়ার আর কিছুই ছিল না। এখন পরিস্থিতি আরও মারাত্মক। নিজেদের আহাম্মকির ফল হিসাবে পাকিস্তান যায় যায়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মীমাংসা খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই, সামরিক মীমাংসাও ক্রমেই অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং এ সময়ে ভারতকে ধ্বংস কর’ ‘হিন্দুস্থান আমাদের এক নম্বর দুষমন, এসব। ধ্বনি আওড়ানাে ছাড়া আর গতি কী। যুদ্ধ, বিশেষত জয়ের উদ্দেশ্য লইয়া যুদ্ধে নামিতে হইলে অবশ্যই সামর্থ্য প্রয়ােজন, কিন্তু আত্মহত্যার বােধহয় তাহার খুব প্রয়ােজন নাই। পাক জঙ্গীগােষ্ঠী হয়তাে মরার আগে ভারতকে একটা মরণ কামড় বসাইতে চাহে।
ইতিপূর্বে দুই দুইবার সে চেষ্টা করিতে গিয়া পাকিস্তানের সমর-দানৰ দাত ভাঙিয়াছে। এবারও সেই নিয়তিই তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। হয়তাে এবার আর শুধু দাতের উপর দিয়ে যাইবে না; পূর্ববাংলা ইতিমধ্যেই কার্যত হাতছাড়া, আখেরে পশ্চিম পাকিস্তানও যাইতে পারে। তবে এসব চিন্তা পাকিস্তানের প্রভূদের মাথায় নাও ‘আসিতে পারে। কথায় আছে- ঈশ্বর যাহাকে ধ্বংস করিতে চাহেন আগে তাহার বুদ্ধি নাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের গােয়ার্তুমির প্রশংসা কেহ কেহ করিয়াছেন হয়তাে, কিন্তু তাঁহার বুদ্ধির প্রশংসা কেহ করেন বলিয়া’ জানা যায় না। তাহা হইলে তিনি ভারত আক্রমণের লক্ষে বিশ্বযুদ্ধের স্বপ্ন দেখিতেন না। রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় পাক প্রতিনিধি সে জুজুও দেখাইয়াছেন। ইয়াহিয়া খান বড়াই করিয়া বলিয়াছিলেনপাকিস্তানের বন্ধু, বান্ধবের অভাব নাই, আমরা একা নহি’। সঙ্গে তাহার ক’জন মামু আছেন, মাঠে। নামিলেই তাহা মালুম হইবে। অনেকে আশা করিয়াছিলেন- রুশ-ভারত মৈত্রী-চুক্তির পর পাকিস্তান নিশ্চয় নিজেকে সামলাইবে, যুদ্ধের বদলে সমস্যার মীমাংসায় কোনও যুক্তিসম্মত পথ খুঁজিবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাইতেছে ইয়াহিয়া হাঁক ডাক কমাইলেও, মতলব ছাড়েন নাই । অচিরেই নাকি তিনি জাতির কাছে বেতারে কিছু বলিবেন। সে যে ভারতের পক্ষে শান্তি বচন হইবে না চলতি যুদ্ধ প্রস্তুতি তাহা আগাম জানাইয়া রাখিয়াছে। তাহার এই দুঃসাহসের জন্য ইয়াহিয়া খাঁ একাই দায়ী-এমন কথা বলা যায় কি? কাহারা তাহাকে সমরাস্ত্র এবং রসদ সরবরাহ করিয়াছেন তাহা সকলের জানা। সেটা না-হয় বন্ধুকৃত্য। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুদের বােধ হয় উচিত ছিল সময় থাকিতে তাহাকে এই বিপজ্জনক পথ হইতে দূরে রাখা। সেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুট খেলা, সকলেরই আবেদন এক তরফা ভারতের প্রতি। উপ-মহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হইতে পারে এই আশঙ্কায় মােড়লেরা সবাই উদ্বিগ্ন, রজার্স-গ্রোমিকো একমত। সুতরাং, দুই পক্ষেরই কথা ভারতকে সংযত থাকিতে হইবে। পাকিস্তান সম্পর্কে সকলেই উদাসীন, কিংবা উদার। কোসিগিন এমনকি এ প্রশ্নও তুলিয়াছেন-পাকিস্তান কী অজুহাতে ভারত আক্রমণ করিতে পারে? দুবৃত্তের যে ছেলের অভাব হয় না সেটা তাহার অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই, রাওয়ালপিণ্ডির এই ক্ষুদে হিটলারকে নিবৃত্ত করার কথা এখনও কেহ ভাবিতেছেন না।
৭ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা