You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.07 | বেফাস কথার বেসাতি - সংগ্রামের নোটবুক

বেফাস কথার বেসাতি

এদেশের পন্ডিতেরা বলেন-সমকালীন জগতের সঙ্গে পরিচয় থাকিলে যা-খুশি বলিবার অমন ঢালাও অনুমতি তাহারা দিতেন না। সম্ভবত তাঁহারা ওই নির্দেশ দিয়াছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। কূটনীতির চর্চা যাহারা করেন কিংবা প্রশাসনিক দায়িত্ব যাহাদের উপর দেওয়া থাকে তাহারা নিশ্চয়ই এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। প্রশাসন ও কূটনীতিতে যাহারা মন্ত্রগুপ্তির উপর বিশেষ জোর দিয়াছেন তাহারা নিশ্চয়ই জানিতেন বেফাস কথার বিপদ কত বেশি। কাজেই প্রশাসকও কূটনীতিকদের বাগ্‌বিস্তারের অধিকার সেকালেও অস্বীকৃতি ছিল, একালে তাে সে কথা উঠিতেই পারে না। অথচ দেখা যাইতেছে আমাদের দেশে ঝানু প্রশাসক এবং অভিজ্ঞ কূটনীতিকদেরও মুখের বাধন নাই, সাত-পাঁচ না ভাবিয়া অনেক কথাই তাঁহারা দুম করিয়া বলিয়া বসেন যাহার তাল সামলানাে সময়ে সময়ে বেশ কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। | দেখিতেছি বনগায়ে পররাষ্ট্রদপ্তরের সচিব শ্রীকল আশ্বাস দিয়াছেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির আর বেশি দেরি নাই-খুব শীঘ্রই সরকার কাজটা সারিয়া ফেলিবেন। তাঁহার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক তাহাই যেন হয় । বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সরকার গড়িমসি যেন আর না করেন। কিন্তু শ্রীকলের ঠিকে ভুল হয় নাই তাে? সরকার কি সত্যই মনস্থির করিয়া ফেলিয়াছেন যে দুই-দশ দিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিবেন প্রধানমন্ত্রীর উক্তি হইতে মনে হয়, সরকারের দ্বিধা এখনও কাটে নাই। বাংলাদেশের স্বীকৃতি সম্বন্ধে তাহারা পাকা সিদ্ধান্ত লইতে আরও কিছুকাল দেরি করিবেন। তবে যদি আইনগত স্বীকৃতির কথা না তুলিয়া  ব্যবহারগত স্বীকৃতির কথা তােলা যায় তাহা হইলে বলিতে হইবে, স্বাধীন বাংলাদেশকে তাঁহারা অনেক আগেই মানিয়া লইয়াছেন। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা আর পাঁচটা দেশের কূটনীতিকদের মতােই সব সুবিধা ভােগ করিতেছেন। | প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট ও যুক্তিসিদ্ধ। তিনি স্তোক দেন নাই, বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী নীতি এ সম্পর্কে বিধৃত করিয়াছেন। কিন্তু পররাষ্ট্রসচিবের কথা অনেকটা স্তোকবাক্যের মতােই শােনাইতেছে।

তাহার মন্তব্যে ভুল বােঝার অবকাশ বিলক্ষণ আছে। তাঁহার উক্তি হইতে বাংলাদেশের কোটি কোটি স্বাধীনতাকামী নাগরিকের মধ্যে মিথ্যা আশার সঞ্চার হইতে পারে-তাহারা ভাবিতে পারেন, তাহাদের এতদিনের কৃম্প্রসাধন এবার বুঝি সার্থক হইল—তাহাদের স্বাতন্ত্র্য লাভের যজ্ঞে বুঝি পূর্ণাহুতি পড়িল। শরণার্থী শিবিরে যাঁহারা বাস করিতেছেন তাহারাও উৎফুল্ল হইয়া ভাবিতে পারেন, তাহাদের অধীর প্রতীক্ষার শেষ বুঝি হইতে চলিয়াছে, তাহাদের দেশে ফিরিবার জন্য যে পরিবেশের প্রয়ােজন সেটা ভারত সরকার সৃষ্টি করিতে উদ্যত। এ আশার কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে এমন ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী এখনও দেন নাই। তবে কেন পররাষ্ট্র সচিব এমন প্রত্যাশা বাংলাদেশের অধিবাসী ও হিতৈষীদের মনে জাগাইয়া তুলিলেন? তাঁহার মন্তব্য হইতে এ ধারণাই হয় যে, সে সুদিন আসিল বলিয়া। অথচ তাহার কোনও সমর্থন মন্ত্রিসভার নিকট হইতে মিলিতেছে না। | আশঙ্কা হইতেছে শ্রীকল অতশত ভাবিয়া কথা বলেন নাই, তিনি বাংলাদেশের প্রতি সরকারের যে অকুণ্ঠ। সমর্থন আছে সেটা বােঝাইতে গিয়া বেফাস কথাটা বলিয়া ফেলিয়াছেন। তাহার ফলে সরকার যে বেকায়দায় পড়িতে পারেন সে খেয়াল তাঁহার হয় নাই। তাহার অসতর্ক উক্তির এটা একটা কৈফিয়ত বটে, কিন্তু তাহাতে তাহার দোষ খণ্ডায় না। তাহার কথা হইতে মনে হয়, দুনিয়াসুদ্ধ লােক বুঝি আজ বাংলাদেশের সমর্থক। এ কথা ঠিক, সাধারণ লােকের সহানুভূতি নিপীড়িত বঙ্গবাসীর দিকে। কিন্তু কয়টি শক্তিশালী সরকার বাংলাদেশকে মদত দিতে চায় সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অথচ তাহাদের মন না ফিরিলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। একেই তাে বাংলাদেশ-সমস্যা এমনিতেই বেশ জটিল। তাহার উপর মন্ত্রী ও সচিবের দু’ রকম কথার দরুন সে জটিলতা যদি আরও বাড়ে তাহা হইলে সে জট ছাড়ানাে বােধ হয় দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়াইবে। সচিবও যদি ওজন না করিয়া কথা বলেন তাহা হইলে বিভ্রান্তিই শুধু বাড়িবে, সমস্যার কোনও সুরাহা হইবে না।

৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা