You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.07 | পিণ্ডিশাহীর সর্বনাশা খেলা - সংগ্রামের নোটবুক

পিণ্ডিশাহীর সর্বনাশা খেলা

বাংলাদেশের হৃদয় হইতে কবেই বিতাড়িত পাক জঙ্গীচক্র এখনও ওদেশের মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া আছে। গােড়া হইতে তাহার মতলব ছিল পূর্ববাংলার সংগ্রামকে বাকা ও বিকৃতি করিয়া দেখানাে। যেন ওই অ্যুত্থান ইয়াহিয়া শাহীর মিথ্যাচার, প্রতারণা ও অত্যাচারের ফলে ঘটে নাই- সবটাই ভারতের কারসাজি। পাক নায়ক ইয়াহিয়া খা “লে ফিগারাে” পত্রিকায় তাহার কুখ্যাত বিবৃতিতে নালিশ করিয়াছেন যে মুজিবর নাকি ভারতের উস্কানি নহিলে স্বাধীন বাংলাদেশের পথে পা বাড়াইতেন না। বাবু যত বলে পরিষদ তাহার চেয়েও এক কাঠি। বাড়াইয়া বলে, ইহাই রীতি। নিউইয়র্কে পাক রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি এই রীতির ব্যতিক্রম করেন নাই । তাঁহার বক্তব্যের মােদ্দা কথাটা এই যে ভারত পাকিস্তানকে উচ্ছেদ করিতে চাহে। নিজে যে দেশ লক্ষ লক্ষ নাগরিককে ভিটামাটি হইতে উচ্ছেদ করিয়াছে তাহার মুখে এ কথা মানায় বটে। ভারত ছয় শত বৎসরের মুসলিম শাসনের বাদশা লইতে চায়, এমন রােমহর্ষক গালগল্পও হিলালি সাহেব চালাইতে চেষ্টা করিয়াছেন।  রাষ্ট্রপুঞ্জকে আসরে নামানাের পাঁয়তারা কথা নাই তুলিলাম ।  এসব চালে কাজ হয় নাই, পিণ্ডিশাহী তাই অন্য উপায়ে সিদ্ধ করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। একাধারে সামরিক এবং রাজনৈতিক চাল। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আদুল হামিদ খান গােপনে বৈরী নাগা নেতা ফিজো এবং মিজো কুলের অ্যাডভেঞ্চারার লালডেঙ্গার সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক বসিয়াছেন বলিয়া শােনা যায়। ত্রিদিব রায় নামে জনৈক চাকমা-দলপতির সঙ্গেও তাহার নাকি বাৎচিৎ হইয়া গিয়াছে। খুঁজিয়া খুঁজিয়া ভারতের বৈরীরা মক্কেল পাকড়াইতেছেন ভালাে। এই মক্কেলেরা বহুকাল দেশত্যাগী। কাহারও আস্তানা লন্ডন, কেহ বা অন্যত্র প্রবাসী। সকলের মিল এইখানে যে ইহারা মূলত পূর্বাঞ্চলের এবং ঘােলাজলে মাছ ধরায় প্রত্যেকেরই বিলক্ষণ উৎসাহ। এখানে ওখানে ঘােরাঘুরি করিয়া, কখনও বা কোল পাইয়াও, বিশেষ জুৎ হয় নাই, কেননা সব চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া পূর্বাঞ্চলে মােটের উপর আজও শান্তি অব্যাহত । আর যেহেতু গণতন্ত্রী সরকারও বহাল, অতএব ভুইফোড় নেতাদের পায়ের তলায় মাটি নাই; ইহারা ঝুলিতেছেন এবং মুরুব্বীদের নেকনজরের জন্য ঝুলঝুলিরও অন্ত নাই। ইহারা ঠাওরাইয়া থাকিবেন যে, হামিদ খাঁ সাহেবকে ধরিলে যদি হিল্লে হয়। এক কথায় আপাতত বেওয়ারিশ রক্ষিতারা বাবু খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। 

বাবু হামিদ খা নাকি তাহাদের কথা দিয়েছেন, পাক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলাইলে অর্থাৎ অন্তর্ঘাতের সামিল হইলে তিনি তাঁহাদের এক একটা তখৃত মিলাইয়া দিবেন। বলা বাহুল্য ফিজো লালডেঙ্গা আর ত্রিদিবের দল সঙ্গে সঙ্গে রাজী এবং নাচিয়াও উঠিয়াছে। দেশদ্রোহীরা ভাবিতেছে এইভাবে তাহাদের খােয়াব ফলিয়া যাইবে। আর একজনের খােয়াব কেমনভাবে ফলিয়াছিল সেই মীরজাফরী নজির তাহাদের বােধহয় মনে নাই। কথা এই যে, ভারতীয় ভূমিতে অন্তর্ঘাতী কুকীর্তি চালানাের মতাে হিম্মৎ ফিজো-লালডেঙ্গা-ত্রিদিব। রায়দের কতটা অবশিষ্ট আছে। পূর্বাঞ্চলে আজ স্থিতির লক্ষণ স্পষ্ট। বিদ্রোহী নাগারা নিজেদের টিকাইয়া রাখিতেই ব্যস্ত। ক্রমেই গভীর হইতে গভীরতর স্তরে গণতান্ত্রিক শিকড় ছড়াইয়া পড়িতেছে। মনে হয় না যে এই গাঁয়ে মানে না আপনি-মােড়লদের হম্বিতম্বির চেয়ে বড় কোন সম্বল রহিয়াছে। পাকিস্তান কী চায় আমরা জানি, ভারত কী করিবে কথা সেইটাই। ইতিপূর্বে নাগাদের সঙ্গে তাহাদের যােগসাজসের বিস্তর প্রমাণ মিলিয়াছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি নাশকতার পিছনেও দেখা গিয়াছে পাকিস্তানী হাত । ভারত তবু সরকারি ভাবে কোনও ব্যবস্থা লয় নাই। নীরবতাই যে তাহার একমাত্র উত্তর ও প্রতিক্রিয়া। দেশদ্রোহীর সঙ্গে পাকিস্তানের হাত মিলানাে আর মিতালী নির্লজ্জ নগ্ন প্ররােচনা; তাহা সামরিক ব্যবস্থারই সামিল। সাবভারশন বা অন্তর্ঘাত এমনই একটা খেলা, যাহা, যে-কেহ ইচ্ছা করিলে খেলিতে পারে। আর । ভারতের তাহা প্রয়ােজন নাই, কারণ বাংলাদেশ নিজেই বিদ্রোহী। তবু ভারত সক্রিয়ভাবে কিছু করিবে না, এই আশ্বাসে ঝুঁদ হইয়া হামিদ খানেরা যদি যা-খুশি-তাই অনাচার চালাইয়া যান, তবে তাহার পরিণাম কী? পিণ্ডি কি ভাবিয়াছে বরাবরই সে রেহাই পাইয়া যাইবে? সে কি ভাবিয়া দেখিয়াছে, দেশদ্রোহীদের লইয়া এইভাবে খেলিতেই থাকিলে শেষ পর্যন্ত সর্বনাশা খেলাটা ঠেকিবে কোথায়?

৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা