You dont have javascript enabled! Please enable it!

জঙ্গীশাহীর নূতন চাল

রুশ-ভারত শান্তিচুক্তির পরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান দিন কয়েকের জন্য শান্ত ছিলেন। আবার তাহার লাফালাফি, দাপাদাপি শুরু হইয়া গিয়াছে। প্যারিসের এক সংবাদপত্র প্রতিনিধির কাছে তিনি হুঙ্কার। ছাড়িয়াছেন দরকার হইলে তিনি ভারতের সঙ্গে লড়াই করিবেন, এবং সে লড়াই হইবে- “টোটাল ওয়ার”। ভারত ইয়াহিয়া এবং তাহার পূর্বসূরীদের নিকট হইতে এ-জাতীয় অনেক হুমকি শুনিয়াছে। তাহার জবাব। দেওয়ার হিম্মত যে এদেশের আছে তা পাকিস্তানের জঙ্গী নায়কেরা একাধিকবার সে প্রমাণও পাইয়াছেন। সুতরাং ইন্দিরাজী “না জেনানা, না দেশনেত্রী” ।, এ ধরনের নানা অদ্র অসৌজন্যমূলক প্রলাপপুর পরও ইয়াহিয়া খানের দম্ভোক্তিকে হয়তাে অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে তিনি যে-সব কথা বলিয়াছেন তাহা বােধ হয় নিছক প্রলাপ নহে, রীতিমত ইঙ্গিতবহ। ইয়াহিয়া, চক্রান্তকারী, একজন সাধারণ ভাড়াটে জেনারেল ইয়াহিয়া মুজিবরকে আখ্যা দিয়েছেন। একটি “বিল্লি, মুজিব এখন তাহার কাছে “ক্ষুদে ফ্যাসিস্ট”, আর তিনি নিজে একজন গণতন্ত্রসেবী, পাকিস্তানের ত্রাতা। বস্তুত ইয়াহিয়ার কথাবার্তা এমন উদ্ধত এবং রুচিবিগহিত যে, “লে ফিগারাে’ এই সাক্ষাৎকার বিবরণের পাশাপাশি একটি সলজ্জ সম্পাদকীয় ছাপাইয়া পাঠকদের জানাইয়া দিয়াছেন- এই সব। উক্তি হজম করা কষ্টকর হইলেও আমরা নিরুপায়, কথাগুলি আমাদের নয়, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের। | এই খােলাখুলি কথাবার্তায় ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে জানাইয়া দিয়াছেন- যদিও পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গার ইতিমধ্যে অনেক রক্ত বহিয়া গিয়াছে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও নানা পরিবর্তন সূচিত হইয়াছে, রাওয়ালপিণ্ডির জঙ্গীচক্রের মনােভঙ্গী তবু অপরিবর্তিত। ইয়াহিয়া মুজিবর এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনও আপসে রাজী নহেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের নাম কাটা যাইতেছে, সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পরােয়ানা জারী হইতেছে। এসব নিশ্চয়ই আপস-চিন্তার ফল নয়। “মুজিবর বাঁচিয়া আছেন”এই সংবাদের বেশি তিনি আর কিছু বলিতে নারাজ। মুজিবর কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে তাঁহার বক্রোক্তিঃ ফরাসী প্রেসিডেন্ট কি জানেন, দেশের কোন্ অপরাধী কোন্ কারাগারে। বাংলাদেশের দেশত্যাগী নাগরিকদের সম্পর্কেও তিনি নির্লজ্জের মতাে উদাসীন। সত্তর-আশি লক্ষ নহে, ভারতে শরণার্থীরা সংখ্যায় বড়জোর কুড়ি লক্ষ ।

ইয়াহিয়ার কথা তাহারা একদিন ফিরিবে, তখন বাছিয়া ঘরে তুলিলেই চলিবে।  অর্থাৎ ইয়াহিয়া এখনও তাহার আদি মতলব হাসিল করিতে বদ্ধপরিকর। তিনি মুজিবরকে দণ্ড দিবেন। রাষ্ট্রপুঞ্জে পাক প্রতিনিধির মতে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিচার শুরু হইয়াছে, এবং দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই সে প্রহসন নাকি সাঙ্গ হইবে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ এবং দেশের এক বিপুল জনগােষ্ঠীকে তিনি দেশের বাহিরেই নির্বসিত রাখিতে চাহেন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে তিনি উপনিবেশ বলিয়াই মনে করেন।  লক্ষণীয় বাংলাদেশের গণহত্যা এবং ভারতে শরণার্থীদের ভিড় উপলক্ষে বিশ্ব-জনমত যাহাই বরুক, ইয়াহিয়া গো ছাড়িতেছেন না। তবে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য অবশ্য তাঁহার চেষ্টার অন্ত নাই । ইয়াহিয়া ভারতের পরে ব্রিটেনকে তাহার পহেলা দুশমন বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। বন্ধু নাকি একমাত্র চীন, ফ্রান্স। “কিঞ্চিৎ সহাভুতিশীল”। তা সত্ত্বেও মামুদের ধরাধরি করিয়া তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকে বাংলাদেশকে উহ্য। রাখিবার জন্য কসুর করিতেছেন না। অন্যদিকে আসরে রাষ্ট্র পুঞ্জকে নামানাের জন্যও চেষ্টার অন্ত নাই। ত্রাণের নামে সেটা যে এক ষড়যন্ত্র আমেরিকার কাগজে তাহা ফাস হইয়া যাওয়ায় সেক্রেটারি-জেনারেল। গোসূসা করিয়াছেন। তাহার আপত্তি ভারত কেন সে সব অকথা-কুকথা অন্যদের শুনাইতেছে। এইসব কূটনৈতিক ক্রিয়াকলাপ যাহাতে আরও জোরদার করা যায় ইয়াহিয়া খান সে-জন্য তাহার ২৮ জুনের ভাষণ। মাফিক, অন্য কাজেও হাত দিয়েছেন। প্রকৃত বাদশার মেজাজে তিনি বলিয়াছিলেন- অক্টোবরের ২৭ তারিখে ঘুম হইতে উঠিয়া প্রথমে যাহার মুখ দেখিব তাহার হাতেই ক্ষমতা তুলিয়া দিব। ইয়াহিয়া তাহার আগেই। বাংলাদেশে এমন একখানা মুখ খুঁজিয়া লইয়াছেন। অসামরিক গভর্ণর নিযুক্ত হইয়াছেন ডাঃ মালিক।

তিনি  কে বা কী, সে প্রশ্ন অবান্তর। নুরুল আমিন পর্যন্ত পিছু হটিয়া গেলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জেও দৌত্য করিতেও নাকি। তিনি অসন্মত। সুতরাং, কালাে ঘােড়া ছাড়া উপায় কী। ইয়াহিয়া লেজ ধরিয়াই ঝুলিয়া পড়িয়াছেন। ডাঃ। মালিককে তিনি খেলতে দিয়েছেন, এবং তাহাকে প্রাণে বাঁচাইয়া রাখার জন্য টিক্কার বদলে অন্য ফৌজী পাহারাওয়ালারাও বহাল হইয়াছেন- এটাই সংবাদ। লক্ষণীয় ব্যাপার এই, তথাকথিত ক্ষমতার হাত বদল হইল পূর্বখণ্ডে, পশ্চিমে নয়। এমন কী জনাব ভুট্টো পর্যন্ত এই খেলার চালাকিটা ধরিয়া ফেলিয়াছেন, তিনি। ইহাকে অসামরিক প্রশাসন বলিতে নারাজ। ভুট্টোকে ইয়াহিয়া খান কীভাবে সামাল দেন সেটাই এখন দর্শনীয়। পশ্চিমে ভুট্টোই একমাত্র সমস্যা নহেন। ভুট্টোর দল দ্বিধা। জঙ্গী-জমানাও নাকি বিভক্ত। তদুপরি । আছে ত্রিধা মুসলীম লীগ এবং আঞ্চলিকতার টানাপােড়েন। অকুতােভয় ইয়াহিয়া এবং তাহার সাকরেদরা ইহার মধ্যে- ইয়াহিয়ার এই চাল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করিল মাত্র। এই নৈরাশ্য স্বাধীন বাংলা এখন আরও বাস্তব রূপ লইতে বাধ্য। তাহাতে কিছু আসে-যায় না। ইয়াহিয়া প্রকৃত ডিক্টেটরের মতাে সগর্বে বলিতে পারিবেন আমি ভাঙিয়াছি, কিন্তু মচকাই নাই।।

৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!