এ সফর অসার্থক নয়
ভারত-নেপাল যুক্ত ইশতাহারের বয়ান দেখিয়া মনে হইতেছে শ্রীস্বর্ণ সিংয়ের কাঠমান্ডু-ভ্রমণ বৃথা যায় নাই-নেপাল সরকারকে তিনি বুঝাইতে পারিয়াছেন বাংলাদেশের পরিবেশ এখন শরণার্থীদের ঘরে ফিরিয়া যাইবার মতাে নয়। তাঁহার তিন দিনের সফরের আগে নেপাল সরকারের ধারণা ভিন্ন ছিল বলিয়াই বােধ হয় । বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলিয়া ধরিয়া লইয়া তাহারা ও ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করিতে চাহেন নাই। এখন এ সম্বন্ধে তাহাদের নূতন ভাবনা শুরু হইয়াছে। এটুকু অন্তত তাঁহাদের খেয়াল হইয়াছে প্রায় এক কোটি লােক যে ইয়াহিয়া খার জঙ্গী জমানা ছাড়িয়া নিরাপদ আশ্রয় খুঁজিতে সীমান্তের অপর পারে আশ্রয় লইয়াছেন সেটা নয়াদিল্লির কারসাজি নয়। কী অনুকূল পরিবেশ হইলে বাংলাদেশের বাস্তত্যাগীরা আবার স্বদেশে ফিরিয়া যাইতে পারিবেন তাহার কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা যুক্তি ইশতেহারে নাই। কিন্তু ইঙ্গিতটা অস্পষ্ট নয়-রাজনৈতিক সমাধান বিনা শরণার্থীর দল দেশে ফিরিবেন না। ভারতবর্ষের উদ্ধাতু-শিবির আর-যাহাই হউক, স্বর্গসুখ সেখানে মিলিতেছে না, মেলার কথাও নয়। তবুও যে এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াও লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশু সেখানে কাল কাটাইতেছেন তাহার হেতু ভারতবর্ষে সসম্মানে বাঁচিয়া থাকার একটা সম্ভাবনা তবু আছে—জঙ্গীশাহীর ত্রাসের রাজত্বে মৃত্যুর জন্য দিন-গনার বিকল্প বাংলাভাষীদের কিছু নাই।
নেপাল এতদিনে সত্যের আলোেক দেখিতে পাইয়াছে বলিয়াই পাকিস্তান যে তাহার মত ও পথ পালটাইবে, এমন আশা অবাস্তব। সেখানকার ক্রুর শাসন তাহাতে হয়তাে আরও ক্ষিপ্ত হইয়া অত্যাচারের মাত্রা বাড়াইয়া দিবে। তখন যাহারা এখনও নরক যন্ত্রণা ভােগ করিয়া বাংলাদেশের মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া আছেন তাহারাও বাস্তুত্যাগ করিয়া ভারতবর্ষের দিকে পাড়ি দিতে উদ্যত হইবেন। কিন্তু বাংলাদেশের শশানপুরীতে কতদিন আর মার্কিন অস্ত্র সম্বল করিয়া ইয়াহিয়া খাঁ তাঁহার দুঃশাসন চালাইতে পারিবেন? এত করিয়াও তাহাদের মনােবল তিনি ভাঙিতে পারেন নাই, তাহাদের মেরুদণ্ড শত অত্যাচারে সােজাই থাকিবে। পরাজয় স্বীকার করিতে হইবে অত্যাচারী শাসককে নিপীড়িত জনগণকে নয়-ইতিহাসের ইহাই লিখন। দেখা যাইতেছে বিশ্বরাষ্ট্রসভায় পাকিস্তানের সমালােচকদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়িতেছে। তাহার ভরসা এখন কম্যুনিস্ট চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাহারা এককালে পাকিস্তানী মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হইয়াছিল। নেপালের মতাে তাহাদেরও একে একে চোখ খুলিতেছে। যাহাদের বিভ্রান্তির ঘাের এখনও কাটে নাই ভারতবর্ষের উচিত বাংলাদেশ সম্পর্কে নির্মম সত্য তাহাদের চোখের সম্মুখে তুলিয়া ধরা। পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে হত্যা করা তাে হইয়াছেই, মানবিকতাকেও যে ফৌজী বুটের তলায় পিষিয়া মারা হইতেছে—এ তত্ত্ব তামাম দুনিয়াকে জানাইয়া দেওয়া দরকার। যত বেশি দেশ এ তথ্য জানিবে ততই পাকিস্তানের পক্ষে তাহার মিথ্যার বেসাতি দুনিয়ার হাটে ফেরি করিয়া বেড়ানাে কঠিন হইয়া দাঁড়াইবে।
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা