You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের স্বীকৃতি

প্রধানমন্ত্রীর পশ্চিমবঙ্গ সফরে এই রাজ্যের সুরাহা হইক বা না-হউক, এইটুকু বােঝা গিয়েছে যে, শরণার্থীদের জোর করিয়া জল্লাদের সম্মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইবে না। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে ভারতের অসুবিধা কোথায়, তিনি সেটাও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন । বহির্বিশ্বে একটি জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামকে নিছক পাক-ভারত বিরােধ বলিয়া প্রচারের সুযােগ তিনি দিতে চান না। স্বাভাবিক এবং সঙ্গত ইচ্ছা। স্বীকৃতি কবে? তিনি বলিয়াছেন, যথাসময়ে। এ বিষয়ে তাহার আশ্বাস, পরদেশী কোনও শক্তির মর্জির উপর নির্ভর করিয়া ভারত বসিয়া নাই।। | কথাটা নূতন নয়, কিন্তু নূতন করিয়া শােনার প্রয়ােজন ছিল। পুনঃ পুনঃ উচ্চারণে কোনও কথার চমক নাও থাকিতে পারে, কিন্তু মূল্য নিশ্চয়ই থাকে। এই প্রসঙ্গে তাহার প্রয়ােজন ছিল। কেন না ইয়াহিয়া খান নূতন চাল চালিয়াছেন। এতদিন বাদে একজন কুইসলিং অথবা মীরজাফর যাহারই সন্ধান হউক মিলিয়াছে। অসামরিক শাসক হিসাব ডাঃ মালিক নামে এক অথর্ব গদিয়ান। কিন্তু তিনি টিক্কার মতন জল্লাদ হইতে পারিবেন তাে? আজ বাংলাদেশে নিয়ােগকর্তা ফৌজী, প্রকৃত শাসনও আদৌ যদি কাহারও হাতে থাকে তবে সেটা ভাড়াটে সৈন্য আর রাজাকার নামে লুঠেরাদের হাতে। তবু বোধহয় অসামরিক প্রশাসনের ধুয়া তুলিয়া। শরণার্থীদের জন্য ধুম্রজাল রচনা করা চাই। সত্য বলিতে কী, ইয়াহিয়াও তাে আজও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিচারে নিতান্ত নির্বান্ধব নহেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হইতে এই সহৃদয় ভাবনা প্রয়ােজন ছিল এইখানে যে, বােঝা গেল, ভারতের চক্ষে কিংবা ডাঃ মালিক, কিংবা টিক্কা খান- কোনও প্রভেদ নাই। ডাঃ ডি,পি,ধর স্বীকার করিয়াছেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আপসের কোন আশা নাই।

আগে ভারত আর রাশিয়া দুই দেশই বলিত, বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন পাক, আর পাকিস্তানও থাক্। প্রকারান্তরে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার অনুমােদন, তাৎপর্যপূর্ণ নিশ্চয়ই। লজিক বলিবে, তবে স্বীকৃতি দিতেই বা দ্বিধা কেন? কলিকাতার পর দিল্লিতে, আরও পরে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন ঘটিয়াছে। ইহাদের যে কাজ করিতে দেওয়া হইতেছে সেটা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে। বাস্তবতার স্বীকৃতিসূচক। শরণার্থীদের পক্ষেও সেটা আশ্বাসের। ভারত যে ডাঃ মালিক আর টিক্কা খানের মধ্যে কোনও পার্থক্য স্বীকার করেনা সেটা সােজাসুজি জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ডাঃ ডি,পি, ধরও। বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলিয়া বুঝিয়া লইয়াছেন যে, যাহাকে রাজনৈতিক সমাধান বলা হইতেছে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া তাহার কোনও আশা নাই। বাংলাদেশ সত্য যদি স্বাধীনতা হীনতায় বাচিতে না চায়, তবে তাহার সম্পর্কে কোনও ফয়সালা অন্যে। করিতে পারিবে না। সন্দীপের চরে মার্কিন ঘাঁটির প্রস্তাব নাকি মুজিব প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। আপসে রাজী নয় আওয়ামী লীগও। নূতন ইতিহাস রচিত হইতেছে গেরিলাদের হাতে এবং কাজে। প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ করিবে মুক্তিবাহিনী। সেই যুদ্ধে ভারতও তাহার ইতিহাস-নির্দিষ্ট কর্তব্য করিতে পারিবে। কিনা, প্রশ্ন সেটাই। প্রধানমন্ত্রী সেই ভূমিকার কথা সকলকে খুলিয়া বলেন নাই, খলিয়া বলার কথাও নয়। তবু একটি আশা রহিয়া যায়। ভারতীয় রাজনীতির কর্মধারায় যিনি নূতন ভঙ্গী ও বৈদ্যুতিক ইঙ্গিত। আনিয়াছেন, তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই বা তাহা আনিতে পারিবেন না কেন? আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও নূতন। একটি দৃষ্টিকোণের প্রয়ােজন আছে। মত ও পথের বিভেদ সত্ত্বেও নিছক জাতিবােধের ভিত্তিতে বাংলাদেশে। যে যুক্তফ্রন্ট একদিন সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার নাম আওয়ামী লীগ। এই বাংলাতেই বা তাহা রচিত হইবে না।

৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!