You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তির পথে ধাপে ধাপে

মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে নব পর্যায়ে যে আঘাত হানিতেছে তাহাকে শারদ অভিযান বলা যায়। পাঁচমাস পার হইয়া মুক্তিযুদ্ধ ছয় মাসে পড়িল, পূর্ব-বাংলার সংগ্রামী মানুষের এক অর্থে ষান্মাসিক পরীক্ষা শুরু হইয়াছে। রাওয়ালপিণ্ডির যে উন্মাদের ভাবিয়াছিল আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠাণ্ডা হাে জায়গা তাহারা নিশ্চয় এখন মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছে এবং তাহাদের কোমর অবধি জলে-কাদায় বসিয়া গিয়াছে। ফিরিবার পথ? তাহাও যেন একে একে বন্ধ। সত্যকার জয়লাভ কোনওদিনই সম্ভব ছিল না, বড়জোর ঘটিতে পারিত যাহাকে বলে। সামরিক বিজয়। ইয়াহিয়ার কামান, বন্দুক রক্ত ঝরাইয়াছে বিস্তর, কিন্তু সামরিক জয়লাভও দূর অস্ত। সে আশা পিছাইয়া যাইতেছে, ঘুচিয়া যাইতে বসিয়াছে।  মুক্তিযােদ্ধাদের মার যে নেহাত পিনের খোচা নয় তাহা ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট। এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মঙ্গলায় ডুবিয়াছে অস্ত্র-বােঝাই ছয়টি বিদেশী জাহাজ, নারায়ণগঞ্জে চৈনিক সহযােগিতার যে পন্টুন তৈয়ারি। হইয়াছিল তাহারও নাকি ভরাডুবি ঘটিয়াছে । চট্টগ্রামে আর চাঁদপুরে গিয়াছে চারটি জাহাজ, অন্যত্র আরও ত্রিশটি—তাহার মধ্যে একটি মার্কিণ সমরাস্ত্রবাহী তরী ‘পদ্মা। অর্থাৎ মুক্তিফৌজ অকারণে নিজের নাম পাল্টাইয়া মুক্তিবাহিনী হয় নাই। জলে এই সেনারা লড়িতেছে, লড়িতেছে স্থলেও। জলের কুমীর ডাঙায় বাঘ হইয়া উঠিয়াছে। দেড়শতের বেশী গুরুত্বপূর্ণ রেল বা সড়ক সেতু ধ্বংস, ছােটখাট আরও শত শত । যোগাযােগব্যবস্থা আজও বিচ্ছিন্ন, খান-সেনারা আতঙ্কিত, বাণিজ্য কার্যত স্তব্ধ। একটা অসম্ভব পরিস্থিতিতে জীবনপণ সংগ্রামের ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতেছে বাংলাদেশ। জাতীয় ইতিহাস তাে বটেই, রণনীতির ক্ষেত্রেও নূতন ইতিহাস রচনা করিয়া চলিয়াছে।  নিছক আশাবাদ ইহা নহে। নানা লক্ষণ বড় বড় অক্ষরে বলিয়া দিতেছে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র পাকিস্তানকে রক্ষার নামে পাকিস্তানেরই দফা শেষ করিতে বসিয়াছে। বিনাশযজ্ঞের দুই পুরােহিত বলিয়া এই দুই জনের 

নাম আগামীকালের খাতায় যদি ওঠে। শিল্পবাণিজ্যের মতাে প্রশাসনেও পুরাপুরি অচল অবস্থা। মার্চ মাসের কুখ্যাত হুমকি অনুযায়ী মুজিবকে ইয়াহিয়া কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়াছেন, কিন্তু তাহার দ্বিতীয় বড়াইটা কাজে লাগে নাই। কোনও অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার, কই, কোনও চিহ্নমাত্র তাে নাই! আওয়ামী লীগের কোন কোন সদস্যের নাম কাটা গেল সেটা সাড়ম্বরে জানানাে হইয়াছে, কিন্তু শুন্য স্থান পূর্ণ করিতে আগাইয়া আসিল কে বা কাহারা তাহার কোনও উল্লেখ নাই। পাঁচ মাসেও ইয়াহিয়ার একজন কুইসলিং মিলিল না, এখন দশ মাসে যদি একজন ভুমিষ্ঠ হয়। নহিলে রাজ্যরক্ষা, বংশরক্ষা, মুখরক্ষা কিছুই হয় না। উপরন্তু নিজের শিবিরে তিনি নিজেই সংকট ডাকিয়া আনিয়াছেন। দিন যত আগাইবে, প্রাসাদকুটে চক্রান্ত ততই বাড়িবে। টিক্কা খাঁর উপরে ডা, মালিককে মালিক করিয়া বসাইলে বাংলা যেমন প্রবােধ মানিবে , তেমনই টিক্কাকেও বােধ হয় বাগে আনা যাইবে না। লড়াই চালাইতে চালাইতে ট্যাকেও টান পড়িতে পারে। দরিয়া পার হইয়া যাহারা বাংলার মাটিতে নামিয়াছে, তাহারাও বিগড়াইতে পারে। | মুক্তির লড়াইয়ের আর একটা শুভ লক্ষণ, বৈদেশিক প্রতিক্রিয়া । নিক্সন-প্রশাসন যতই নির্লজ্জ নৃত্য। করুক, বিশ্বব্যাংক এখনও সংযত ও সতর্ক। রুশ-ভারত চুক্তির পরে এবং শ্রীমতী গান্ধীর প্রস্তাবিত সফরের ফলে এই উপমহাদেশে মার্কিন নীতি যােলআনা পাকিস্তান-ঘেঁষা নাও হইতে পারে । মুজিবের বিচার লইয়াই ততা শােনা যায় আমেরিকা গােপনে ইয়াহিয়া খানসাহেবের উপর চাপ দিতেছে। বেঁকিয়া বসিয়াছে সিয়াটোর। দোস্ত থাইল্যান্ডও। সিংহলের নজরও অনুকূলে নয়। কলম্বাে এই মহাদেশে অশান্তির দায় পরােক্ষভাবে নাকি পাকিস্তানের উপরই চাপাইয়াছে। পিন্ডিশাহীর প্রকাশ্য এবং প্রধান বন্ধু বলিতে তবে এখনও বাকী রহিল কে, পিকিং

২৯ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!