You dont have javascript enabled! Please enable it!

সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কেন এই চুক্তি

সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পাদিত ভারতের শান্তি-মৈত্রী সহযােগিতার চুক্তিটি যে বিপুল অভিনন্দন পেয়েছে তা ভারত সরকারেরও প্রত্যাশার অতীত ছিল। রাশিয়া পন্থীরা স্বভাবতই আনন্দে ভরপুর। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা যে অভিযান চালিয়ে আসছিলেন, এতে তারই জয় হল। আমেরিকা পন্থীরা হতচকিত; কিন্তু চুক্তিটিকে সরাসরি নিন্দাও তারা করতে পারছেন না। বহু দিন ধরে নতুন উদ্যোগের অভাবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে একটা অচল অবস্থা দেখা দিয়েছিল। যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে শ্রীমতী গান্ধী তার অবসান ঘটালেন। ভারতের দিক থেকে চুক্তিটি প্রত্যক্ষতই ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে হাত শক্ত করার দিকে লক্ষ্য রেখেই সম্পাদিত। ভারত সরকার আশা করছেন যে এ চুক্তির ফলে জেনারেল ইয়াহিয়ার যুদ্ধবাজ মনােভাব অনেকটা প্রতিহত হবে। তাছাড়া, যে পিকিং এবং ওয়াশিংটন নানাভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করে চলেছে, তারাও এই চুক্তি সম্পর্কে মাথা ঘামাতে বাধ্য হবে। শ্রী নেহরুর আমল থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে একটি প্রধান সমালােচনার বিষয় ছিল-ভারত বিশ্বে বান্ধবহীন। ভারত-রুশ চুক্তি ঐ সমালােচনার কণ্ঠ স্তব্ধ করবে। ভারত ঠিক বন্ধু বাছাই করেছে কিনা সে সম্পর্কে নানাজনের নানা মত থাকলেও সােভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু যে যুদ্ধ তথা শাস্তির সময় ভারতের পাশে এসে দাঁড়াবে তাতে মতভেদের অবকাশ নেই। তাসখন্দ চুক্তির কার্যকারিতা আর বজায় নেই। যে সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে ঐ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে দেশ এখন সিদ্ধান্ত করেছে যে ভারত আর পাকিস্তানকে একই মানদণ্ডে বিচার করা অর্থহীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারত এবং পাকিস্তান—উভয়ের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলায় এবং পাকিস্তানকে চীন এবং আমেরিকার কবল থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। ওয়াশিংটন ১৯৫০-এর দশকে ইসলামাবাদকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাকে চীন। 

এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অনেকগুলি জোটের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেই চীনের সঙ্গে মিতালির জন্য সচেষ্ট হয় এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ভুট্টোর উদ্যমে পিকিং-এর সঙ্গে ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। শ্রী ভুট্টো ১৯৬৬ সালে বরখাস্ত হন; কিন্তু ইসলামাবাদ তার নীতিই অনুসরণ করে চীন-মার্কিন দু তরফের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা টিকিয়ে রাখে। ইতিমধ্যে চীন-রুশ সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে; চীন-মার্কিন বৈরিতাও আগের মতােই চলতে থাকে; তবে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়। ফলে মসকো এবং ওয়াশিংটন উভয়েই চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে চিড় ধরাতে চায় । ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সােভিয়েত ইউনিয়নের হাতে সুযােগ এনে দেয়। তারই উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদিত হয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেবেছিল সে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে মাখামাখি বন্ধ করবে। এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ গ্রহণ করবে। কিন্তু ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যেই সােভিয়েত ইউনিয়ন বুঝতে পারে যে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তার নীতি ফলপ্রসু হয়নি, তাই সে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করে দেয় । মাঝের বছর তিনেক অবশ্য পাকিস্তানের তুঙ্গে বৃহস্পতির অবস্থান চলছিল। সে এমন এক নীতি অনুসরণ করে চলছিল যার দ্বারা আমেরিকা, চীন এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন-তিন দেশের কাছ থেকেই সে প্রচুর অস্ত্র লাভ করে ঐ সব অস্ত্র বলাই বাহুল্য ভারত ছাড়া অন্য কারাে বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করার মতলব তার ছিল না। | পাকিস্তানের প্রতি মসকোর নীতিতে নয়াদিল্লিতে অস্বস্তি থাকলেও ভারত সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায়নি; কারণ সে দেশই চীনের ভ্রুকুটি সত্ত্বেও ভারতকে নানা রকম আধুনিক অস্ত্র এবং বিমান দিয়ে আসছে; অন্ত্রাদির কারখানা গড়ার ব্যাপারে ভারতকে সাহায্য করছে। মসকোর কাছে ভারতের কৃতজ্ঞ থাকার কারণ স্পষ্ট। | আমেরিকা পাকিস্তানকে যেমনটি করেছে ভারতকেও সে ভাবে তারা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের এই চুক্তি করার দরকার হত না। বহু বছর ধরে আমরা আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে এসেছি। এক সময় ভারতই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তম আদর্শগত বন্ধু বলে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রক এক পুস্তিকাও প্রচার করেছিল। ঐ একই কথা বলার জন্য ভারতের অনেক মন্ত্রী আমেরিকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ও পক্ষ থেকে যুক্তিসঙ্গত সাড়া পাওয়া যায়নি আমরাও ওয়াশিংটনের।

১২ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!