প্রতিবাদের নানা ভাষা
দিল্লিতে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে জনসংঘের উদ্যোগে যে বিক্ষোভ-সমাবেশ আয়ােজিত হইয়াছিল তাহাতে নাকি এক অভিনব দৃশ্য দেখা যায়। বিক্ষোভকারীদের হাতে দাবি-খচিত প্ল্যাকার্ড অবশ্য ছিল কিন্তু কেহ কেহ প্রতিবাদলিপি বহন করিয়াছেন নিজেদের পিঠে-নগ্ন ত্বকে। তাহাদের পিঠের চামড়ায় তুলিতে লেখা দাবিপত্র-বাংলাদেশের স্বীকৃতি চাই। মানুষের মতােই বিচিত্র তাহার প্রতিবাদের ভাষা। পােস্টার-প্ল্যাকার্ডশ্লোগান-এ সব সুপরিচিত সুপরিচিত আগ্নেয় আয়ােজন-সমূহের কথাও। কেহ বােমা ফাটান কেহ ট্রাম-বাস জ্বালান, কেহ-বা নিজেকে জ্বলন্ত মশালে পরিণত করিয়া আপন প্রতিবন্ধ নিবেদন করিয়া যান । ভিয়েৎনাম এবং চেকোশ্লেভাকিয়ায় সে দৃশ্যও দেখা গিয়াছে আমরণ অনশনের মতাে এসব হয়তাে প্রবল প্রতিবাদের ভাষা মৃদু প্রতিবাদেরও নানা কৌশল । বাঁধব না, বাড়ব না, বাঁধব না চুল-শুধু যে গৃহস্থঘরেই প্রতিবাদের টেকনিক তাহা নহে, জাতীয় ব্যাপারেও অনেক সময় এসব চলিতে পারে। প্রাচীন গ্রীসে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতে গৃহিণীরা একবার আরও কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহারা যােদ্ধা-স্বামীদের মুখের উপর নাকি শয়নকক্ষের দরজায় খিল আঁটিয়া দিয়াছিলেন । কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ অবশ্যই। তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক কারণে নহে, অন্য অর্থে। সকলেই জানেন মানুষের দেহের চামড়ার উপর অলঙ্করণ এক প্রাচীন প্রথা। খৃস্টপূর্ব দুই হাজার অব্দের ‘মমি’তেও উল্কির সন্ধান মিলিয়াছে। প্রাচীন পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই চামড়ায় এভাবে লেখা-লেখির চল ছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক উপজাতির মধ্যে এই উল্কির আদি সম্পর্ক একটি ছােট্ট কাহিনী আছে। এক বাড়িতে দুটি মেয়ে ছিল। একজন অন্য গায়ে গেল।
সেখানে তাহাকে দেখাশােনা করেন এমন কেহ নাই । পাছে এ বাড়ির মেয়েরা পরে তাহাকে চিনিতে না পারে তা-ই তাহার গায়ে উল্কি আঁকিয়া দিল। মেয়েটি ভিন গায়ে গিয়া বড় হওয়ার পর সকলে সবিস্ময়ে দেখিল উল্কিতে তাহাকে বড়ই সুন্দর দেখাইতেছে। সেই হইতে দেশে উল্কির চল হইল।। সনাক্ত-চিহ্ন এবং সজ্জা ছাড়াও উক্ষি নানা উদ্দেশ্যে আঁকা হইয়াছে। দাসেরা চিহ্নিত হইত এই প্রক্রিয়ায় । আদিবাসী রমণী এবং পশ্চিমের নাবিকের কাছে ইহা হয়তাে রূপসজ্জা। জাদু, চিকিৎসা, যৌনতা-উক্ষির পিছনে আরও নানা ইতিহাস। দিল্লির শােভাযাত্রীদের পিঠে যাহা অঙ্কিত হইয়াছে, তাহা অবশ্য পিঠে উল্কি নহে,-সে লিখন বর্ষা অথবা যমুনার জলে ধুইলেই মুছিয়া যাইবে-তবু স্বীকার না করিয়া উপায় নাই, দুই-ই মূলত একই ক্রিয়া। হেরােডােটাস এক শ্রেণীর গুপ্ত বার্তাবাহকের কথা উল্লেখ করিয়াছেন, তাঁহাদের মাথা মুড়াইয়া সেখানে উক্ষি রচনার প্রক্রিয়ার খবরা খবর লেখা হয়, তাহার পর চুলে তাহা ঢাকিয়া গেলে বার্তাবহ বিদেশযাত্রা করে। দিল্লির বার্তাবহেরা সংবাদ বহন করিলেন পিঠে এবং প্রকাশ্যে।। কেন বিক্ষোভকারী গােষ্ঠী যখন কাহারও কুশপুত্তলিকা দাহ করেন তখন তাহারা যেমন ডাকিনীতন্ত্র অনুযায়ী কোনও অনুষ্ঠান উদ্যাপন করেন না, ঠিক তেমনই দিল্লির বিক্ষোভকারীরাও নিশ্চয় জানিতেন না। তাহারা এভাবে একটি লুপ্তপ্রায় প্রাচীন প্রথাকে স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন। প্রথাটি আদিমতার স্মারক বলিয়া লজ্জার কোনও হেতু নাই। বরং বলিব প্রতিবাদের এই প্রাচীন ভাষাটি অনেক তথাকথিত আধুনিক ভাষার চেয়ে অনেক বেশী সভ্য যেমন সভ্য কাহাকেও জ্যান্ত পুড়াইয়া মারার চেয়ে তাহার খড়ের মূর্তি দাহ করা। কারণ, প্রথমত এই ভাষা লিখিত, অর্থাৎ কর্ণবিদারক নহে। দ্বিতীয়ত কথাগুলি লেখা হইয়াছে প্রাণহীন কাগজে | নয়, অন্যের পিঠেও নয়—নিজের চামড়ায়। মনের ভিতরে প্রতিবাদ যখন টগবগ করিয়া ফোটে তখনই বােধ হয় তাহা আপন ত্বকে ফাটিয়া বাহির হইতে পারে। সুতরাং অধিকতর বিশ্বাসযােগ্য। দর্শকের মনে হইবে, এই পিঠের লিখন মনের কথারই অভিব্যক্তি,-নিছক শেখানাে বুলি নয়।
১৪ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা