অত্যাচার, ভ্রষ্টাচার, না বিচার
আজ মুজিবের বিচার। ধৃষ্ট জঙ্গী ঘাতকেরা বিচারের নামে প্রহসনের দিনটি ঘােষণা করিয়া দিয়াছে, অদ্যই শেষ রজনী’ দয়া করিয়া এইটুকু মুখে আনে নাই, এই যা। ইয়াহিয়া দেশের আইনের দোহাই পাড়িয়াছেন। কিন্তু সকলেই জানে আইনের রচয়িতা ভাষ্যকার সবই তিনি নিজেই। যিনি ফরিয়াদি তিনিই হাকিম এক্ষেত্রে ফরিয়াদি আবার একটি উর্দিপরা উন্মাদ। বাহুবলের মত্ততায় বেসামাল একটি ব্যক্তি, যে নিজে আগের মনিবকে সরাইয়া গদিতে বসিয়াছে, সে বিচার করিবে সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত নায়ককে, একটা দেশের সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রীকে। জনগণের উপর ক্ষিপ্ত আক্রমণ চালাইয়াও জঙ্গীশাহীর তৃষ্ণা মেটে নাই, এবার তাই সে জনমন অধিনায়ককে লইয়া পড়িয়াছে। মুজিবের অপরাধ নাকি যুদ্ধাপরাধ । কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার হয় আন্তর্জাতিক আদালতে, ইহাই তাে জানি । নিউরেমবার্গে যেমন হইয়াছে। তেমন একটি আদালতে তবে ইয়াহিয়ার ও বিচার আবশ্যক। জনগণের বিরুদ্ধে, একটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ-অপরাধে অপরাধী ইয়াহিয়া নিজেই। ভারত প্রতিবাদে মুখর। স্বর্ণ সিং হুশিয়ার করিয়া দিয়াছেন কিন্তু দায়িত্ব একা ভারতের নয়, খালি তাহার প্রতিবাদেই কুলাইবে না। মুজিবের ফাসি উপলক্ষে অনেকেই সাড়া দিয়াছিলেন। জিজ্ঞাসার জন্য আন্তর্জাতিক আন্দোলন হইয়াছে। স্পেন, হাঙ্গেরী ইত্যাদি দেশের লেখকদের নিগ্রহ হইতে রক্ষা করিতে দুনিয়ার বুদ্ধিজীবীরা আলােড়ন জড়াইয়াছেন। কিন্তু মুজিবের বেলায় কাঁদিবে একা ভারত, তাও সকলে সমস্বরে নয়, অনেক আচ্ছন্ন, ভ্রান্ত বিকারগ্রস্তের মূঢ় বিচার তাহার সঙ্গে মিশিবে? চেলাদের হিংসায় তালিম দিয়া যাহারা। নিরাপদ নেতা হইয়া বসিয়াছেন, তাহারা এমনই মানবিকতার দীক্ষা দিয়াছেন বটে। কিন্তু মুজিব একটা জাতির গণতান্ত্রিক নেতা, তাহাকে লক্ষ্য করিয়া ছুরিকা আস্ফালন-এই স্বৈরাচারী কুকীর্তির তুলনা নাই। ইহার সঙ্গে যাহারা অন্য ইস্যু মেশান, তাঁহারা ইচ্ছা করিয়া সময়ের সঙ্গে সততার সঙ্গে, বিবেকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মূলটাকে ধামা চাপা দিয়া সেটা সমাজকে ধাপ্পা দেওয়ার অপচেষ্টা। মুজিবর সংস্কৃতির নায়ক, গণতান্ত্রিক নায়ক, জাতীয় নায়ক। তিন পরিচয়েই তিনি আমাদের কালের এক।
অগ্রগণ্য পুরুষ, এই উপমহাদেশের অন্য এক ব্যক্তিত্ব। তাবৎ দুনিয়ার সরকারগুলিই বা কী করিতেছে? অত্যাচার আর ভ্রষ্টাচারকে বিচার বলিয়া চালানাের স্পর্ধার মুখে তাহাদের মৌনীবাবা সাজিয়া থাকা ন্যাকামি এবং পাপ-এই পাপ ক্ষালনের পথ নাই । ইয়াহিয়ারা সবই পারে। নির্বিকার, খুশিতে নির্বাচন নাকচ, গণহত্যা, নির্বাচিত নেতাদের বিচার । মুজিবরের নিধনও তাহাদের পক্ষে অসম্ভব নহে। কিন্তু ওই কোরবানিতেই কি। বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়া আসিবে ইতিমধ্যেই শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক নাগরিকেরা’ দুর্ধর্ষ গেরিলায় পরিণত। ঘটনাস্রোত, ইতিহাসের অনিবার্যতা, একটি জাতির স্বাধীনতাস্পৃহা ইয়াহিয়াদের তােয়াক্কা না রাখিয়াই। মােহনার দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। আমরা সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিলিয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দিয়াছি, ভালই। সেটা প্রথম পদক্ষেপ। এবার সত্যকার শান্তির পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। বাংলাদেশ সরকারকে। স্বীকৃতি পরােক্ষভাবে ওই দেশের দলিত সংগ্রামী মানুষদের সম্মান দান। কিন্তু সময় বহিয়া যাইতেছে। বাংলাদেশ হয়তাে একদিন সম্পূর্ণ স্বাধীন হইবে-কিন্তু সেই স্বাধীনতার সৌধ যদি নিহত মুজিবের অস্তির উপর। নির্মিত হয়, (এই মানুষটি কিছুতেই-অত্যাচারীর হাজার পীড়নেও বােঝাই যাইতেছে যে, ভাঙেন নাই, মচকান। নাই, করেন নাই নতিস্বীকার; তাই তাঁহাকে হত্যার এই আয়ােজন।) তবে সে-লজ্জা, সেই শােকের কোনও সান্ত্বনা থাকিবে না। আজ আবেদন বাংলাদেশের প্রতি অনুকুল প্রতিটি দেশের দরবারে, আবেদন ইয়াহিয়ার। বন্ধুদের কাছেও। আর, আবেদন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের নিকটে । তাহারাও আজ কাঠগড়ায়-বিশ্বমানুষের এজলাসে আগামীকালের দরবারে।
১১ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা