You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.05 | প্রাণ বাঁচান- মুজিবের মুজিবের - সংগ্রামের নোটবুক

প্রাণ বাঁচান- মুজিবের মুজিবের

মুক্তির জন্য এই প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধ বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ ভাবিয়া । ইহার লক্ষ্য তাবৎ দুনিয়ার যাবতীয়। সরকার, ইহার লক্ষ্য জনগণ। জনমত জাগিয়া উঠুক, প্রবল প্রতিবাদে ফাটিয়া পড়িয়া জানাইয়া দিক “এ হইতে পারে না, একটি জাতির অবিসংবাদী জননায়কের প্রাণ স্বৈরাচারী ঘৃণ্য ঘাতকের হাতে যাইতে পারে। হত্যাকারী ইয়াহিয়া খান আবার তাহার ছুরিতে শান দিতেছেন। হিংসা সীমাহীন, তঁাহার স্পর্ধা অব্যাহত। বাড়িতেছে দিনে দিনে। ২৫ মার্চ হইতে ২৮ জুন-তিন মাস বহিয়া যাইবার পর ইয়াহিয়া প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলার সাহস পান, নিজের বিশ্বাসঘাতকতার সব দায় আওয়ামী লীগের উপর চাপান। একটু একটু করিয়া আগাইতেছেন ইয়াহিয়া, চোর যেমন সিঁধের মধ্য দিয়া সন্তপর্ণে হাড়ি লাঠি ইত্যাদি নাড়াইয়া পরখ করে, গৃহস্থ কতখানি সজাগ। ইয়াহিয়াও তেমনই। মুজিব এবং তাহার দলকে খােলাখুলি গালি দিয়া যখন বুঝিলেন সহিয়া গিয়াছে, বিশ্ব তেমন শিহরিত হইল না, ধিক্কারও দিলনা, তখন তিনি আর এক কদম বাড়িয়া গিয়া বিদেশী সাংবাদিকদের জানাইলেন, মুজিবের বিচার হইবে। প্রথমে বি-বি-সি, পরে ‘ফাইনানসিয়াল টাইমস্ সেই হঠকারী জবানী প্রচার করিল। সে সব গত মাসের মাঝামাঝি। ইয়াহিয়া মুখ খুলিয়াছেন আবার, নৃশংসতায় যিনি কংসেরও মামা, সেই জঙ্গী নায়ক জানাইয়াছেন অক্টোবরের আগেই মুজিবের প্রাণনাশ করা হইতে পারে। বিচার অবশ্য একটা হইবে- সামরিক বিচার, অর্থাৎ প্রহসন তথা জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ট্র্যাজেডিও।  স্বৈরাচারীরা ইহাই করে । হালে যখন পানি পায় না তখন। খান সেনারা বাংলাদেশে যাহা করিয়াছে, সে কীর্তির পাশে নাত্সী ঝটিকা বাহিনীর অত্যাচার তুচ্ছ, রাশিয়ার “গ্রেট পাৰ্জ” (১৯৩৬-৩৮), চীনের লাে জুইচিং পরিচালিত কীর্তিও মান। সবগুলি যােগ দিলে যা দাঁড়ায় তাহা ঘটাইয়াও বাংলাদেশের প্রাণ যখন বিনষ্ট করা গেল না, ইয়াহিয়া তখন খৰ্গ উদ্যত করিয়াছেন। লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর প্রাণ। শত্রুর শেষ রাখিতে নাই, কূটবুদ্ধি শাসক জানিয়াছেন এই কৌটিল্য বাক্যই শেষ কথা। শুধু তাহাকে একটা আইনের মােড়ক দিতে হইবে। এই বিচারের নৈতিক বা আইনগত এক্তিয়ার তাহার। কতখানি সে বিষয়ে ইয়াহিয়া নির্বিকার। কেননা তাহার শক্তি আছে। বাহুবল, তাহার কাছে সেইটাই শেষ যুক্তি। রাজদ্রোহের অপরাধে জননেতার বিচার বিদেশীর হাতে ইতিহাসে তাহার নজির ঢের ।  

চিরস্মরণীয় মিলিবে পরাধীন ভারতে। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, ভকত সিং প্রভৃতি,– যাহাদের জীবনে লভিয়া জনম একটা জাতি জাগিয়া উঠিয়াছে।  কিন্তু ইয়াহিয়াকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাইতে দেওয়া হইবে কেন? প্রতিবাদী কোটি কোটি হাত অগ্রসর হইয়া ধৃষ্ট ঘাতকের হাত কেন চাপিয়া ধরিবে না? ব্যাপারটা যখন গােপনে ঘটিতেছে না, আততায়ী প্রকাশ্যেই যখন বুক বাজাইয়া খুনের অগ্রিম নােটিশ দিতেছে হুমকির বিরুদ্ধে লােকসভায় নিছক উত্তেজনায় কুলাইবে না, সরকার স্বয়ং “চরম উত্তেজনা” বােধ করিলেও না। টুঙ্কু আবদুর রহমানের মারফত প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াস কতদূর কার্যকরী হইবে জানি না। ইতস্তত আবেদন-নিবেদনে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হইবে কিনা সন্দেহ। প্রচণ্ড চাপ চাই, প্রবল আলােড়ন। | এখনও যদি আলােড়ন প্রবল না হইয়া থাকে, তাহার একমাত্র কারণ অনেকেই ঠিক বিশ্বাস করিতে চান যে, ইতিহাসের নির্লজ্জতম, নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডটি সত্যই সংঘটিত হইবে বা হইতে পারে। অনেকে ভাবিতেছেন, এ শুধু হাওয়া। কিন্তু হাওয়াও ঝড়ের আকার লইতে পারে, লইয়া থাকে। অশ্রুতপূর্ব একটি জনমতের রায় ইয়াহিয়া হঠাৎ একদিন বুটের তলায় থেঁতলাইয়া দিবেন, এ কথা ২৫ মার্চের আগে কেহ কি ভাবিয়াছিল? যতদিন ঢাকায় বৈঠক চলিয়াছে ততদিন আশায় আশায় কাটিয়াছে। তারপর ঠকিয়াছেন। সকলেই, ঠকাইয়াছেন এই ইয়াহিয়া। ইতিহাস এমনই অনেক অবিশ্বাস্যতার কণ্টকে-কঙ্করে আকীর্ণ। আত্মতুষ্টি ভয়ঙ্কর। আলােড়ন নহে, চাই আন্দোলন। তাহার একমাত্র ধ্বনি “প্রাণ বাঁচাও”। নিবৃত্ত যাহারা। করিতে পারেন তাহাদের নীরবতা ভাঙিতে হইবে। বধ্যভূমির দিকে উল্লাসে অগ্রসর জল্লাদকে বাধ্য করা হউক। কারণ ইয়াহিয়া খানেরা রাশি রাশি জন্মায়, শুক পাতার মতাে রাশি রাশি খসিয়াও যায়, কিন্তু মুজিবর রহমানেরা প্রত্যহ জন্মান না, তাহারা আসেন দৈবাৎ ।। সরকারি স্তরে যতদূর সম্ভব ততদূর করা হউক, জগজীবন রাম যাহাকে বলিয়াছেন “চরম উত্তেজনা তাহা চরম ব্যবস্থার জন্য সকলকে প্রস্তুত রাখুক। সেই সঙ্গে বাহিরে প্রয়ােজন বলিষ্ঠ, সােচ্চার জনমত, দিকে দিকে হত্যার হুমকির বিরুদ্ধে ধিক্কার ও বিক্ষোভ। কোথায় আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, কোথায় ছাত্রশক্তি? কঙ্গো বা অ্যাঙ্গোলার চেয়ে বাংলাদেশ আমাদের অনেক কাছের, একেবারে পাশের দেশ। সুতরাং অন্য উপলক্ষে যাহা ঘটিয়াছে তাহার চেয়েও শতগুণে বিক্ষোভ দেখা দিবে না কেন; কেন রাজপথে মিছিলের প্লাবন বহিবে , দিকে দিকে ডাকা হইবে না জনসমাবেশ? বিবেক বলিয়া যদি কিছু থাকে, অনুমাত্র অবশিষ্ট থাকে মানবতা তবে তাহা অন্তত এইবার প্রকাশিত হউক। এখানে এবং দুনিয়ার সর্বত্র দিকে দিকে দীপ্যমান হউক রােষ, দিকে দিগন্তে প্রবল প্রচুর প্রতিবাদ পুঞ্জ পুঞ্জ হইয়া উঠুক। আর, একবাক্যে সকলে বলুক “মুজিবের বিচার? না। জিঘাংসু ইয়াহিয়ার বিচার চাই আগে।”

৫ আগস্ট, ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা