You dont have javascript enabled! Please enable it!

পরমাণু-অস্ত্র ও ভারত

বিশ্বের যে কয়টি রাষ্ট্র পরমাণু শক্তির মারাত্মক প্রয়ােগের ক্ষমতা ও ব্যবস্থা অধিগত করিতে পারিয়াছে, তাহার মনােভাবে এবং আচরণে বারংবার ইহাই বুঝাইয়া দিতে চাহিয়াছে যে, মর্যাদায় তাহারা যেন বিশেষ এক কুলীন-শ্রেণীর রাষ্ট্র। পরমাণু-শক্তি হইল তাহাদের কুল্লক্ষণ, সুতরাং শুধু তাহারাই বিশিষ্ট এক কৌলীনার। আসরে বসিয়া সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রিক অদৃষ্টের শান্তি-অশান্তির প্রশ্ন লইয়া বিবেচনা ও আলােচনা করিবার অধিকারী। পুর্বে এই সব কুলীন রাষ্ট্রের সম্মিলিত ইচ্ছায় আলােচনার একাধিক বৈঠক হইয়া গিয়াছে। সম্প্রতি সােভিয়েত রাশিয়া এইরূপে একটি আলােচনার বৈঠক আহ্বান করিবার প্রস্তাব করিয়াছে। সােভিয়েতের প্রস্তাব চীনকেও আহ্বান করিয়াছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন-পরমাণু-শক্তি যাহাদের। কুল্লক্ষণ তাহারা বৈঠকে সম্মিলিত হইয়া আলােচনা করিবে, পরমাণু-অস্ত্রের বিভীষিকা হইতে কী উপায়ে বিশ্ব জীবনকে নিরাপদ করিতে পারা যায়। চীন এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়াছে। চীনের অভিমতের একটি দাবি এই যে, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের শীর্ষ-সম্মেলন আহ্বান করিতে হইবে।

পরমাণু-অস্ত্র নির্মাণ ও মজুত করিয়া যাহারা মারাত্মক পরাক্রম সঞ্চয় করিয়াছে ও করিয়া চলিয়াছে । তাহারা কি সত্যই নিজ নিজ পরমাণু-শক্তিকে নিবীর্য করিবার আগ্রহে আলােচনার বৈঠকে সম্মিলিত হইতে। চাহে? ইহা একটি কঠিন সন্দেহের প্রশ্ন বটে, কিন্তু অযৌক্তিক প্রশ্ন নিশ্চয়ই নহে। পরমাণু-শক্তির রাষ্ট্রগুলি এই প্রশ্নের অকপট উত্তর কখনও দেয় নাই, দিবেও না। তাহাদের মনােভাবের এবং ইচ্ছার যে, পরিচয় মাঝে। মাঝে বেশ স্পষ্ট হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলে তাহাতে এই সত্য বুঝিয়া লইতে কাহারও অসুবিধা হয় না । যে, পরমাণু-অস্ত্রের সঙ্গতি যাহাদের আছে তাহাদের লইয়া শক্তিগত স্বার্থের একটা আপােষমূলক সংহতি। নির্মাণ করাই প্রধান উদ্দেশ্য। আর একটি সাধারণ উদ্দেশ্য হইল এমন এক অঙ্গীকার প্রভাবিত করা যাহার। ফলে বিশ্বের কোন ষষ্ঠ রাষ্ট্র যেন পরমাণু-শক্তির মারাত্মক প্রয়ােগের ক্ষমতা অধিগত করিতে উৎসাহিত না।  ভারত শক্তিধর কয়েকটি রাষ্ট্রের আণবিক রক্ষাচ্ছত্রের প্রতিশ্রুতিকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। চীনের। অভিমতে যাহা দাবি করা হইয়াছে, ভারতও ইতিপূর্বে বস্তুত তাহা দাবি করিয়াছিল। সমগ্র রাষ্ট্রের শীর্ষসম্মেলন আহ্বান করিবার চীনা প্রস্তাব তাই ভারতের নীতিতেও সমর্থিত হইবে। কিন্তু ভারতের পক্ষে এই বাস্তব সত্যটিকে আর অস্বীকার করিবার সাধ্য নাই যে, পরমাণু-অস্ত্রের শক্তি অধিগত না করিয়া এবং শুধু নৈতিক আবেগে পরমাণু-অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে শান্তিবাদী তত্ত্ব প্রচার করিয়া ভারত বিশ্ব-জনমতে কোন প্রভাব। সৃষ্টি করিতে পারে নাই। দ্বিতীয় সত্য, এশিয়া মহাদেশে শুধু এক চীনের পরমাণু-অস্ত্র সমন্বিত হইবার ঘটনা লক্ষ্য করিয়াও ভারতের পক্ষে শুধু পরমাণু-শক্তির শান্তিতত্ত্ব লইয়া প্রসন্ন হইয়া থাকিবার কোন অর্থ হয় না। পরমাণু-অস্ত্র নির্মাণের কর্তব্যে অহিংসা আদর্শের কোন প্রশ্ন আসে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের রিপাের্টে বলা হইয়াছে পাকিস্তান ও চীনের সামরিক সম্পন্নতার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া ভারতীয় প্রতিরক্ষার শক্তি উন্নত করা হইতেছে। কিন্তু কই চীনের পরমাণু-অস্ত্রের মারাত্মক উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে সতর্ক হইবার উপযােগী সক্ষম  প্রতিরােধের জন্য ভারত কী পরমাণু-অস্ত্র নির্মাণ করিতে আজিও সচেষ্ট হইয়াছে?

অন্য বৃহৎ রাষ্ট্রর পরমাণু অস্ত্র হইল, হইল বহির্বিশ্বে তাহাদের রাজনীতিক প্রভাব বিস্তারিত করিবার একটি প্রয়ােজনের বস্তু। কিন্তু ভারতের পক্ষে নিতান্ত আত্মরক্ষার প্রয়ােজনের বস্তু। বৃহৎ বিশ্বের শান্তির তুলনায় ইহা ভারতের পক্ষে কম নৈতিক সত্য নহে। শ্রী নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজনীতিক অবস্থার মধ্যে পরমাণু-অস্ত্রের কোন প্রয়ােজনপূর্ণ সার্থকতা দেখিতে পান নাই। কিন্তু সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষার সম্মুখে ঘটনা ও সম্ভাবনা সেদিনের তুলনায় অনেক বেশী কঠোর ও জটিল হইয়াছে। শত্রুতার শিবিরে পরমাণু-অস্ত্র সঞ্চিত হইয়াছে। সুতরাং, ভারতের পক্ষে এখনও পরমাণু-অস্ত্রের প্রয়ােজন সম্পর্কে পুরাতন নৈতিক বৈরাগ্য পােষণ করিবার অর্থ দেশরক্ষার কর্তব্যের মধ্যে একটি ভয়ানক ছলনা পুষিয়া রাখিবার ব্যাপার’ বলিয়া অভিযােগ করিবার যুক্তি আছে।

৪ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!