You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতের সাফ জবাব

রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব সকাশে ভারতের নিবেদন সবিনয়, কিন্তু সুস্পষ্ট স্বরে। এ দেশে রাষ্ট্রপুঞ্জ-প্রতিনিধি রাখা চলিবে না, সাফ জবাব। সীমান্তের ওপারে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি সম্পর্কে ভারত কিছু বলে নাই। ভালই করিয়াছে । ওদিকে কে আসিবেন, কে থাকিবেন, যাইবেনই-বা কে, সেটা সম্পূর্ণ ওখানকার জঙ্গীশাহী, মুক্তিফৌজ এবং বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপার। এ বিষয়ে আগ বাড়াইয়া কিছু বলিলে ইয়াহিয়ার মনস্কামনাই সিদ্ধ হইত, পিণ্ডি বলিয়া উঠিত-এই যে ভারত আমাদের ব্যাপারে নাক গলাইতেছে। আর তাহার বিশ্বস্ত। হিতৈষী উ থান্ট মহাশয় সব বিশ্বাসও করিতেন, কেননা তিনি যেটা নিছক পাক জঙ্গীশাহীর অত্যাচার আর জনগণের মুক্তি-সঞ্জাম, তাহাকে পাক-ভারত বিরােধের চেহারা দিতে যেন উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছেন। | মনে হয়, এই শুভ সঙ্কল্পে তাহার দোসর আমেরিকাও। বাংলাদেশে তলে তলে নাকি ৭৩জন পর্যবেক্ষক বসানাের ব্যবস্থা পাকা, অবশ্যই স্যাম চাচার আশীর্বাদ লইয়া। সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে জীবনমরণ লড়াইয়ের হাল আর বীভৎস অত্যাচারের খবর নির্ভুলভাবে সংগ্রহ করিবেন মাত্র ৭৩ জন মনিটর? প্রতি দশ লক্ষ মানুষের জন্য একজনও পড়ে না, এই তাে হিসাব এই তাে ন্যায় বিচার এবং কান্ডজ্ঞান। ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা প্রস্তাবটাকে সমুদ্রে এক বিন্দুর চেয়েও হাস্যকর বলিয়াছে। তা ছাড়া দখলদার-বাহিনী যখন পৈশাচিক কীর্তি চালাইয়া যাইতেছে তখন ইউএন-মার্কা টুপিপরা কেহ নিকটেই আছে, ইহাতে যাহারা মরিতেছে তাহাদের সান্ত্বনা কোথায়? পর্যবেক্ষকেরা নিধন, লুণ্ঠন উৎসাদনের নীরব সাক্ষী বই তাে কিছু হইবেন না। না, শ্রীযুক্ত থান্ট, এত সহজ রাস্তায় ইতিহাসের এত বড় অন্যায়ের প্রতিকার হয় না। ক্লীব রাষ্ট্রপুঞ্জের দূতগণের উপস্থিতি জবরজং নায়কদের তাহাদের নীতি হইতে এতটুকু টলাইতে পারিবে বলিয়া মনে হয় না। বরং ওই উপস্থিতিটাই না একটা স্যাংশন’ হইয়া যায়। আজ বাংলাদেশে যাহা দরকার, তাহা ভারত অত্যন্ত পরিষ্কার জানাইয়া দিয়াছেন। দূর মুলুকের এক হামলাদার-বাহিনী সেখানে বাড়ি-চড়াও হইয়াছে। মূল সমস্যা এই এবং এই অপরাধে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক দরবারে অপরাধী। একমাত্র প্রতিকার রাজনৈতিক সমাধান, শেখ মুজিবের বিচার নহে, মুক্তি এবং বিশ্বের সব শক্তিমান জাতিকে বলিয়া দিতে হইবে, ইয়াহিয়া খান যতদিন না তাহার শিকারী হাউণ্ডের দল ফিরাইয়া লইতেছেন, ততদিন সামরিক, অর্থনৈতিক সব সাহায্য বন্ধ । কুটনৈতিক ক্রেতায় হুঁকো-নাপিত বন্ধ করা ইহাকেই বলে।

তা সাত মণ তেল কবে পুড়িবে, রাধা নাচিবে কী? আশা অল্প। কিন্তু প্রথম কথা, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আস্থা ও স্বস্তি ফিরাইয়া আনা। সম্ভাব্য বাস্তুত্যাগীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ রচনা-তবে তাে তাহাৱা ভয় হইতে অভয়মন্ত্রে দীক্ষিত হইতে পারিবে। | সমাধান আরও একটা আছে-মুক্তিফৌজের চূড়ান্ত সাফল্য। সে আশা এখনও সুদূর কিন্তু গত ইঙ্গিত মিলিতেছে। আর কুমিল্লা এলাকায় সাফল্য, বরিশাল, ফরিদপুর হইতে খান সেনার হটিয়া আসার সম্ভাবনা স্বয়ং ইয়াহিয়া খাকে তওবা বলিতে বাধ্য করিয়াছে। ইতিপূর্বে মুক্তিফৌজের অস্তিত্বই যিনি স্বীকার করেন নাই, তিনি সংগ্রামী সেনাদের শক্তি ক্রমেই বাড়িতেছে, এই কথা কবুল করিয়াছেন। অবশ্য সেই সঙ্গে ইহাও  বলিয়াছেন যে, চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করা হইবে। কিন্তু আর কী উপায়ে খাঁ সাহেব। আর কত নররক্তে হাওয়া ঘুরিতেছে পাকিস্তানের নিজেরই কূটনৈতিক মহলে। একের পর এক কর্মী চাকুরি ছাড়িয়া বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাইতেছেন। শুধু দিল্লিতে নহে, পাশ্চাত্যেও নানা স্থানে। আর সেইজন্যই কি ব্ৰিত ইয়াহিয়া মুখরক্ষা করিতে দ্বারস্থ হইয়াছেন আন্তর্জাতিক সাঙাতদের আর তাই তাহার তরফেরও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িতেছে। তৎপরতা কেন, ইহাকেও অফেনসিভ-আক্রমণ বলা যায়। তাঁহার একক পাপের যজ্ঞে ভারতকে চড়ানাের চেষ্টার আর কোনও অর্থ হয় না। নিরাপত্তা-পরিষদের সদস্যদের কাছে উ থান্টকে দিয়া চিঠিচাপাটি চালান দেওয়া একটা চক্রান্ত একটা ফাঁদ। বিস্ময়কর নহে যে ভারত এই ফাদে পা বাড়াইয়া দিতে রাজী হয় নাই, অসম্মতি জানাইয়াছে জোর গলায়। বিস্ময়কর খালি এইটুকু যে উ থান্টের অপচেষ্টার কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন সংসদে বিলকুল অস্বীকার করিয়াছিলেন কেন? তিনি কী জানিতেন না? অথচ তাহার পরেই সরকারপ্রচারিত বয়ানে, থলির ভিতর হইতে বিড়াল বাহির হইয়া পড়িয়াছে। উহা তাে কোনও যুদ্ধ ঘােষণার ব্যাপার নয়, বাজেট কিংবা অনুরূপ কোনও আর্থনীতিক ব্যবস্থাও না তবে অকারণে সেদিন তিনি সবটা চাপিয়া গিয়াছিলেন কোন “জনস্বার্থে? উহার পর অন্যান্য এবং সামান্য বিষয়েও সরকারী মুখপাত্রদের বিবৃতি-স্বীকৃতি। অস্বীকৃতিতে চট্‌ করিয়া কে বিশ্বাস করিবে?

৪ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!