You dont have javascript enabled! Please enable it!

উথান্টের ন্যক্কারজনক পাঁয়তারা

বিশ্বজোড়া নাম ডাক উ থান্টের। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল তিনি। যে কোন সমস্যার সমাধানে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী তার কাছে প্রত্যাশিত । কিন্তু উ থান্ট হতাশ করছেন সবাইকে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে-এই ভদ্রলােক কী রাষ্ট্রসংঘের নিরপেক্ষ প্রবক্তা, না, মার্কিন আজ্ঞাবহ? পঁচিশে মার্চ থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। গণহত্যা। নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে মরেছে হাজারে হাজারে। সত্তর লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে ভারতে । গণহত্যা যুদ্ধের জন্য অনেকেই মাথা কুটেছেন রাষ্ট্রসংঘের দরজায় । উ থান্টের মুখে এক কথা-ওটা পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যা। একেবারে হিজ মাস্টারস ভয়েস। মার্কিন কর্তারা তুলেছিলেন এ ধ্বনি। উ থান্ট। করেছেন তার প্রতিধ্বনি। মহাফ্যাসাদে পড়েছেন ইয়াহিয়া খান । বাইরের আর্থিক সাহায্য বন্ধ হবার উপক্রম। বৈদেশিক বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে সঙ্কট। বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা অচল। গােটা দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। তার উপর চলছে মুক্তিবাহিনীর পাল্টা মার। পাক.. নাজেহাল। ভারতের দিকে ছুটে আসছে শরণার্থীদের দ্বিতীয় তরঙ্গ। তাদের আগমনের দৈনিক হার আবার বাড়ছে। পুনর্বাসনমন্ত্রী খাদিলকার বলছেন-শীঘ্রই শরণার্থীদের সংখ্যা পৌঁছবে এক কোটিতে। মার্কিন আশ্রিত ইয়াহিয়া খান। বিশ্বজনমতের ধিক্কার নেমে এসেছে তার উপর। আশ্রিতের মুস্কিল আসানের জন্য উদ্বিগ্ন আমেরিকা। রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী। দপ্তরের হাই কমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দিন পাক-প্রেমিক। আয়ুবের ছেলের সঙ্গে তার নাকি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক। এঁর মাথা থেকে বেরিয়েছে বাংলাদেশ সমস্যার উদ্ভট সমাধান। লুফে নিয়েছেন তা মার্কিন কর্তারা। তাদের ইঙ্গিতে এ পরিকল্পনা বাজারে ছেড়েছেন উ থান্ট। ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তে মােতায়েন হবে রাষ্ট্রসংঘবাহিনী। আমেরিকা জোগাবে টাকা । শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ওরা দেবে উৎসাহ। স্বদেশে ফিরলে করবে তাদের পুনর্বাসনের তদারকী । সঙ্গে সঙ্গে থাকবে সম্ভাব্য পাক-ভারত সংঘর্ষ বিরােধের চেষ্টা। এ নিয়ে স্বস্তি পরিষদের বৈঠক ডাকতেও স্বার্থান্বেষী মহল আগ্রহান্বিত । স্বস্তি পরিষদের বৈঠকে আপত্তি নেই কারও। কিন্তু তার বিবেচ্য বিষয় কী হওয়া উচিত? অবশ্যই ইয়াহিয়ার গণহত্যার নিন্দা এবং বাংলাদেশে লােকায়ত সরকার প্রতিষ্ঠার উপায় উদ্ভাবন।

এই মৌল প্রশ্নের ধারে কাছে যাচ্ছেন না উ থান্ট। তার চোখের সামনে ভাসছে দুটি পক্ষ-ভারত এবং পাকিস্তান। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তি বাহিনী হিসাব থেকে একেবারেই বাদ। এদের বাদ দিয়ে হতে পারে না বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধান। আর এ সমাধান না হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে না পূর্ববাংলায়। তা না ফিরলে শরণার্থীরা ভরসা পাবে না স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। গণহত্যা এবং পাইকারীহারে বাঙালী বিতাড়নের অপরাধে অপরাধী ইসলামাবাদ। নয়াদিল্লি আর্তদের অশ্রয়দাতা। একই পর্যায়ে পড়তে পারে না মানবপ্রেমিক ভারত এবং মানঘাতী পাকিস্তান। এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাচ্ছেন উ থান্ট। মৌল প্রশ্ন ছেড়ে লেজ ধরে টানাটানি করছেন তিনি। বাংলাদেশের আসল পক্ষ হচ্ছে-দখলদার ইসলামাবাদ এবং স্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। বােঝাপড়ার দরকার এদের মধ্যে। মহাধূর্ত ইয়াহিয়া খান। তিনি ভারত সীমান্তে চালাচ্ছেন হামলা। দুনিয়াকে বােঝাতে চাচ্ছেন—পাক-ভারত লড়াই অনিবার্য। তার মতে, মুক্তিবাহিনীর নেই কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। প্রকৃত প্রস্তাবে ওটা ভারতীয় ফৌজ। ইসলামাবাদের এই মিথ্যা প্রচারের আস্কারা দিচ্ছেন রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াই-এর সময়ও দেখাগেছে উ থান্টের সত্য গােপনের অদ্ভুত কেরামতী। কাশ্মীরে হানাদার পাঠিয়েছিল পাকিস্তান এবং করেছিল ছাম্ব আক্রমণ। রাষ্ট্রসঙ্রে পর্যবেক্ষক দলের নেতা নিশ্মি যথারীতি পাঠিয়েছিলেন রিপাের্ট। বৃটিশ প্ররােচনায় এ রিপাের্ট চেপে রেখেছিলেন মহামান্য সেক্রেটারি জেনারেল । তার কৃপায় এবং মার্কিণ গােষ্ঠীর প্রভাবে আক্রমণকারী পেল না তার প্রাপ্য ধিক্কার। আক্রান্ত এবং আত্মরক্ষাকারী সমভাবে সাজল আসামী। ফরিয়াদী এবং বিচারক হলেন স্বস্তি পরিষদ। কোন আন্তর্জাতিক সমস্যায় যদি জড়িত থাকে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে সেখানে স্বস্তি পরিষদ এবং সেক্রেটারি জেনারেলের ভূমিকা হয়ে পড়ে খুবই নােংরা। প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বাকে সাহায্য করার ফরমান নিয়ে কঙ্গোতে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল হ্যামারশােল্ড। বৃটিশ এবং মার্কিন স্বার্থে ঘাতকের হাতে তিনি তুলে দিয়ে। 

এসেছিলেন তাঁর আশ্রিত লুমুম্বাকে। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল আক্রমণ করল মিশর। সবাই জানল একথা । জানল না স্বস্তি পরিষদ। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার নারকীয় কাহিনী অজানা নেই গােটা দুনিয়ার । ঠুলি আঁটা রয়েছে মার্কিন কর্তাদের চোখে। ওঁরা দেখতে চান না সত্যের উজ্জ্বল আলােক। হয়ত তা সহ্য করতে পারেন না। আসল সমস্যার পাশ কাটান তাঁদের চিরাচরিত অভ্যাস। এ অভ্যাসেরই পরিণতি ইয়াহিয়ার পৃষ্ঠরক্ষা। উ থান্টের প্রস্তাবের নেই কোন বাস্তব মূল্য। জঞ্জালের ঝুড়িতে ওটা ফেলে দিয়ে ভালই করেছেন নয়াদিল্লি। তারা দিয়েছেন ঝঝাল উত্তর। কিন্তু অবাক করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বর্ণ সিং। গত আটাশে জুলাই রাজ্যসভায় তিনি নির্বিকার চিত্তে বললেন-ভারত সরকার পান নি উ থান্টের কোন প্রস্তাব। তিনি কি হাওয়ার। উপর চলেন? রাখেন না কোন সংবাদ?

৩১ জুলাই, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!