কূটনীতিকদের নিগ্রহ
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের যে মহাকাব্য রচিত হইয়া চলিয়াছে, সেই কাব্যের একটা উপেক্ষিত দিকও। আছে। ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার এবং তাহার ১৩০ জন সহকর্মীর ভাগ্য। কাব্যের উপেক্ষিত, এমন কী। যেন সংবাদেরও উপেক্ষিত। গত চার মাস ধরিয়া পাক জঙ্গীশাহী আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে, সভ্য জগতের সৰ কেতাকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া আমাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদিগকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে। একতরফা হুকুম জারী হয় এপ্রিলে-একতরফা হুকুমে তখনই পাকিস্তান, কলিকাতায় তাহার এবং ঢাকায়। আমাদের, দুইটি দুতাবাসই বন্ধ করিয়া দেয়। তাহার আগেও সপ্তাহ কয়েক সহচরসহ ডেপুটি হাই-কমিশনার। শ্রীসেনগুপ্ত ছিলেন কার্যত নজরবন্দী। তাহার পরে কী এখন শুরু হইয়া গেল পাকাপাকি কারাজীবন? পাকিস্তান। তাহার নিজেদের নাগরিকদের লইয়া যাহা খুশি তাহা তাে করিতেছেই, কিন্তু ভারতীয় নাগরিকদের নিগ্রহ-এ। অধিকার তাহাকে কে দিল? | আগে শােনা গিয়াছিল শ্রীসেনগুপ্ত ঢাকার গুলশান উপনগরীর একটি বাড়িতে সামরিক প্রহরায় বেষ্টিত। তাহার চুল কাটিতে যাওয়ারও সুযােগ-স্বাধীনতা নাই। কাগজ বলিতে যােগান দেওয়া হইত ফৌজী। হুকুমনামা-সংবলিত স্থানীয় কিছু পত্র। তবু বাহিরের সঙ্গে কথা বলার, সহকর্মীদের কথা শােনার, একটা। উপায় ছিল-টেলিফোনে। সর্বশেষ সংবাদ, তাহাও বন্ধ, টেলিফোনের তার কাটা পড়িয়াছে। বস্তুত কাটা। পড়িয়াছে আন্তর্জাতিক আচরণের শেষ লেশটুকুও। গণহত্যার জল্লাদদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নহে। মুক্তিযােদ্ধারা খাস রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ-সরবরাহ বিপর্যস্ত করিয়া দিয়াছে, তাহার জবাবেই কী পাক কর্তৃপক্ষের এই তৎপরতা? কুটনৈতিক দুনিয়ায় ইয়াহিয়ার । চেলারা তবে চমক্কার এক গেরিলাবাহিনী তৈয়ারি করিয়াছে। কিছুকাল আগে শ্রীমতী সেনগুপ্তার প্রতি আচরণ, কূটনৈতিক বার্তাবহদের হয়রানি, প্রসঙ্গত সে সবও স্মরণীয়। টেলিফোন নিতান্ত যান্ত্রিক বিভ্রাটে । অচল, এই অজুহাত টিকিবে না। শ্রীসেনগুপ্ত, মনে রাখিতে হইবে, সাধারণ একজন গ্রাহক’ নন। বিকল যদি ।
কিছু হইয়া গিয়া থাকে, তবে সেটা নানাভাবে নাজেহাল ইয়াহিয়া শাহীর কাণ্ডজ্ঞান। পাকিস্তান গােড়ায় বাংলাদেশের ব্যাপারটাকে বলিয়াছিল ঘরােয়া ব্যাপার। পরে মতলব এবং মওকামাফিক সে নিজেই আত্মখণ্ডন করিয়া চলিয়াছে—মুক্তি-সংগ্রামকে চাহিতেছে পাক-ভারত বিবাদের চেহারা দিতে। তবু দুনিয়ার হাটে সুবিধা বিশেষ হয় নাই, সকলেই স্বীকার করিয়াছেন, ভারতের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক এবং প্রতিবেশী, এই হিসাবে মাত্র । কোটিপ্রায় বাস্তুহারার চাপ ভারতের উপরেই আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু সে-জন্য শ্রীসেনগুপ্তকে আটক করা কেন? তাহাকে ধরিয়া রাখিলেই মুক্তিকামী বাংলাদেশ নতজানু হইবে, ইহাই যদি পিণ্ডির হিসাব হয়, তবে সে হিসাব ভুল ও মিথ্যা। হইতে পারে কলিকাতায় বাংলাদেশ মিশনের বিদ্রোহের অন্য কোনভাবে বদলা লইতে না পারিয়া জঙ্গীশাহী এখন এই রাস্তা ধরিয়াছে। মেহেদী মাসুদকে পাঠাইয়া নানা ছলে জল ঘােলা করার অপচেষ্টাও ব্যর্থ। এই সেদিন নিরপেক্ষ সুইস প্রতিনিধিরা জনে জনে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছেন—এখানকার ৬৫ জন ভুতপূর্ব পাক কূটনীতিকের প্রত্যেকেই স্বেচ্ছায় বিদ্রোহী, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁহাদের অটল আনুগত্য। সকলেই আশা করিয়াছিলেন, পাঁচ জনের সামনে এইভাবে কানমলা খাওয়ার পর পাকিস্তান আর ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনারকে লইয়া ঘাটাঘাটি করিবে সসম্মানে সদল-বলে ফিরিয়া আসার ব্যবস্থা করিবে। কিন্তু মুক্তির বদলে বাড়তি হয়রানি, কূটনৈতিক বিচারে পাকিস্তানের পরাজয়ের ইহাই ফলশ্রুতি। এই ব্যাপারে পাক-পিকিং মিতালিটার আরও একটা দিক দেখা গেল। দুই দেশ জঙ্গী আঁতাতে গাঁটছাড়া তাে বাঁধিয়াছেই, কূটনৈতিক কেতাতেও উভয়ের একেবারে হাতধরাধরি । সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় কূটনৈতিকদের প্রতি অসদাচরণের চূড়ান্ত নমুনা দেখা গিয়াছিল চীনে, এখন এতদিন পরে পিকিং সে সব অভিযােগ নিজেই কবুল করিতেছে। চৈনিক লিপির উপর দাগ বুলাইয়া পাকিস্তান এখন হাত মকশাে করিতেছে মাত্র। করুক কিন্তু পরিণাম বা সম্ভাবনার কথা এই গুরু-মারা চেলারা যেন খােয়াবে বিভাের হইয়া একেবারে না ভােলে। ইয়াহিয়ার কথামতাে যে-কোনাে দিন পাকিস্তান নাকি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করিতে পারে। খাঁ সাহেবের বন্ধুভাগ্য ভাল। পশ্চিমী চাচাদের তিনি জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিতে পারেন-সেকালে এ সব ক্ষেত্রে এক-একটা শক্তিমান দেশ কূটনীতিকদের মর্যাদা রক্ষার জন্যও যুদ্ধ ঘােষণা করিত।
২৭ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা