ইয়াহিয়া খার হুমকি
অতঃপর এ বিষয়ে বােধহয় সন্দেহের আর কোনও অবকাশ রহিল না যে, ইয়াহিয়া খা এবং তাহার জঙ্গীচক্র সত্যই কবরের মুখে। খান সাহেব হুমকি দিয়াছেন- বিশ্ববাসী জানিয়া রাখ, আমি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করিব। পাছে আর সকলে এই দম্ভোক্তিকে পাগলের প্রলাপ বলিয়া উড়াইয়া দেয় সেই ভাবনায় ইয়াহিয়া এই বীরত্বপূর্ণ ঘােষণার সঙ্গে আরও একটি বাক্য জুড়িয়া দিয়াছেন। তিনি জানাইয়াছেন- সেই লড়াইয়ে পাকিস্তান মােটেই নিঃসঙ্গ থাকিবে না। অর্থাৎ, তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়া অন্যেরাও ভারতের বিরুদ্ধে লড়িৰে। ইয়াহিয়া খান অবশ্য সেই খুঁটি ঘাঁটিগুলির নাম করেন নাই। তবে বােঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাহার- রণস্পৃহা আন্তরিক। পাকিস্তানের এক উজির-ই-আজম একদা ভারতকে মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখাইয়া বীর হিসাবে খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। আর এক নবাবজাদা পণ করিয়াছিলেন। তিনি হাজার বছর লড়িবেন। সুতরাং ইয়াহিয়া খানের এই বাসনা ঐতিহ্যসম্মত। তিনি নিশ্চয় ওয়াকিবহাল আছেন তাহার পূর্বসূরী আর এক খান সাহেব সত্যই ভারতের সঙ্গে একহাত লড়িয়াছিলেন। বাইশ-দিনব্যাপী সে লড়াইয়ের ফলাফলও তাহার অজ্ঞাত থাকার কথা। নয়। সেই ক্ষত চাটিতে চাটিতেই আয়ুব বিদায় লইয়াছেন। ইয়াহিয়া নিজে আরও বিপাকে। এই মুহূর্তে বিশ্বের হীনতম জেনারেল তিনি। কারণ, তিনি নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। বােধ হয় দীনতমও। কারণ সে লড়াইয়ের শেষ দেখা যাইতেছে না। রক্তপাতে রক্তপাতে সৈন্যবাহিনী শবের মতাে সাদা হইয়া আসিয়াছে। ঠিক তখনই বিরাট বিপুল প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের বাসনা। প্রতিজ্ঞা যখন, বন্ধুরা রাওয়ালপিণ্ডির আশেপাশে ঝুদির কেল্লার মতাে কোনও নকলগড় গড়িয়া দিলে ঘা সাহেবের বিলক্ষণ উপকার হয়।
ইয়াহিয়া খার যে যুদ্ধের ক্ষমতা নাই সেটা তর্কাতীত। তাহার হুকুম ছিল আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশকে ঠাণ্ডা করা চাই। তাহার সাকরেদ টিক্কা খাঁ নাকি এক সময় দিল্লি দখল করিতে চাহিয়াছিলেন, এখন ঢাকা-ই তাহার হাতে আছে কী নাই । ইয়াহিয়া খাঁ এ মাসের ২৪ তারিখে দিন পাঁচেকের জন্য জায়গীর পরিদর্শনে যাইতে চাহেন, কিন্তু টিক্কা খা নাকি বলিতেছেন- সবুর! কেননা, যুদ্ধ যদিও চতুর্থ মাসে, কিন্তু বাংলাদেশে শান্তি দূর অস্ত। প্রশাসন পরিবহন হইতে শুরু করিয়া চাষবাস, ব্যবসাবাণিজ্য- সব বিপর্যস্ত। তাহার চেয়েও উদ্বেগজনক ব্যাপার, মুক্তি যােদ্ধারা ক্রমেই আরাে বেপরােয়া। যে বাহিনীর মূল ঘাঁটি দেড় হাজার মাইল দূরে তাহার পক্ষে পরদেশে এই অবস্থায় টিকিয়া থাকা কতখানি শক্ত ব্যাপার সহজেই তা অনুমেয়। তদুপরি, সর্বশেষ সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তানও নাকি ধূমায়িত। ভুট্টো বেজার। সিন্ধুতে ধরপাকড়। চলিয়াছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানও নাকি বাংলাদেশের পথে পা বাড়াইতে চায়। এক কথায় ইয়াহিয়া খান আজ শরশয্যায়। ঠিক তখনই যুদ্ধের হুমকি-বিস্ময়কর বইকী। তাহা হইলেও ইহাকে নিছক হুমকি বলিয়া গ্রহণ না-করাই ভাল। কেননা, যেসব কারণেই ইয়াহিয়ার পক্ষে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করা অসম্ভব বলিয়া মনে হয়, বস্তুত ঠিক সেই কারণেই রাওয়ালপিণ্ডির জঙ্গীচক্রের পক্ষে এ-জাতীয় অ্যাডভেঞ্চার সম্ভব। প্রথমত পশ্চিম-পাকিস্তানীদের নৈরাশ্য ইহাতে কিছু প্রশমিত হইতে পারে। একবার রণদামামা বাজাইতে পারিলে প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র, মুজিবরের বিচার প্রহসন, ভুট্টোকে।
ক্ষমতা না-দেওয়া- ইত্যাদি সব অপরাধ চাপা পড়িবে । গরম আবহাওয়ার সবই আবার সাময়িকভাবে একটু গরম বােধ করিতে পারিবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশ হইতে সরাইয়া ভারতে নিবন্ধ হইবে। একটা রীতিমত আন্তর্জাতিক নাটকও জমিয়া উঠিতে পারে । ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের ইচ্ছা প্রকাশ, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষক মােতায়েনের প্রস্তাব- সবই ওই লক্ষ্যে ইয়াহিয়ার ভূমিকা মাত্র। ইহাতে কাজ হইতেছে । বলিয়াই পাক এলাকায় গােলাবর্ষণ, ভারতীয় বিমানের আকাশসীমা লঙ্ঘন ইত্যাদি হরেক অভিযােগ। উঠিয়াছে। ভারত ধৈর্যের পরীক্ষায় জিতিয়াছে, ইয়াহিয়া খাঁকে হঠাৎ “চলাে দিল্লি হাঁক দিলে চলিবে কেন? তাহার আগে একটা মামলা খাড়া করা চাই। একথা মনে করিবার কারণ আছে, ইয়াহিয়া বিদেশের কোনও কোনও তরফের আস্কারাও পাইয়া। থাকিবেন। তাহা না হইলে পিণ্ডির পাগলেরা হয়তাে কাশ্মীরে কিছু “হানাদার” পাঠাইবার চেষ্টা করিত, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার হঠকারিতা দেখাইত না। অবশ্য খান সাহেব “জিরাে আওয়ার” এর আগে । একটু “যদি রাখিয়াছেন। | তিনি বলিয়াছেন, পাকিস্তান তবেই যুদ্ধ ঘােষণা করিবে যদি ভারত পূর্ব বাংলায় কোন অঞ্চল দখল। করিতে চায়। বলা নিষ্প্রয়ােজন, ইয়াহিয়া খান যে-কোনও মুহূর্তে বলিতে পারেন- এই শর্ত পূর্ণ হইয়া । গিয়াছে। কারণ মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিদিনই বাংলার মাটিতে তাহাদের দখল বাড়াইতেছেন। এবং ভারতও সাফ । জানাইয়া দিয়াছে গুলির জবাব গুলিতেই দেওয়া হইবে। খাঁ সাহেব এবার কী করেন- সেটাই দেখিবার। তবে হাঁ, যুদ্ধ-ঘােষণায় তাহার একটা সাক্ষাৎ উপকারও অবশ্য হইতে পারে, বাংলাদেশ হইতে পাততাড়ি। গুটাইবার সেটাই বােধহয় সহজতম এবং সংক্ষিপ্ততম পথ । বর্তমান পরিস্থিতিতে হয় তাে রাওয়ালপিণ্ডির। জেনারেলদের পক্ষে সবচেয়ে সম্মানজনক পথও।
২১ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা