ইয়াহিয়া খান যাহা চান
যাক, একটা সমস্যা চুকিল। “বাংলাদেশ” সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বলিতে কী কী বােঝায়, তাহার অর্থ। আর হাতড়াইয়া বেড়াইতে হইবে না। আমরা যাহা বুঝিয়াছি সেটা জমাই রহিল, কেননা ইতিমধ্যে তিনি যাহা বুঝিয়াছেন, ইয়াহিয়া খান সেটা একেবারে জলের মতাে বুঝাইয়া দিয়াছেন । জঙ্গীতন্ত্র পাকিস্তানে নূতন সংবিধান চাপাইয়া দিবে, যতজন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের সদস্যপদ খারিজ করিলে মতলব হাসিল হয়। ততজনকে নাম-কাটা সিপাই করিয়া দিবে; এককথায় জাতীয় পরিষদের চেহারাই যাইবে বদলাইয়া সেই সংবিধান অবশ্যই ঐসলামিক ভিত্তির উপর স্থাপিত হইবে, এবং যতদিন না হয় ততদিন জঙ্গী জমানাই কায়েম। ইহার পর আর-কিছু বলার রহিল না। আহা, খাঁ সাহাবের ফরমান যেন শীখের করাত, যাইতেও কাটে, আসিতেও কাটে। তাহার রাজনৈতিক মীমাংসার মােদ্দা কথাটা এই। ভারতকে গালাগালি, নিজ দেশের অর্থনীতি লইয়া বুক-চাপড়ানি, এসব প্রত্যাশিত এবং অবান্তর।। শুধু একটা খট্রা থাকিয়া যায়। সামরিক সালসাতেই তাে এতকাল বেশ চলিতেছিল, হঠাৎ আবার সাধিয়া রাজনৈতিক হাতুড়ে চিকিৎসার কথা কেন? তবে কী ফৌজী ফয়সালায় কুলাইতেছে না? মাথার তাজের মধ্যে অস্বস্তির কাঁটা ঢুকিয়া বাদশাজাদার তন্দ্রা ছুটিয়া যাইতেছে? অথবা কারণটা উল্টাও হইতে পারে। এতদিনে হানাদারেরা একেবারে নিশ্চিন্ত। বুঝিয়াছে বিশ্ববিবেকের টিকিটিও নড়িবে না, একটি হাতও আগাইয়া আসিবে না বাধা দিতে । তাই স্বস্তির হাই ছাড়িয়া পিণ্ডির শাহেন শা তাঁহার দ্বিতীয় প্রস্থ মতলব মেলিয়া ধরিয়াছেন। কূটনৈতিক মঞ্চে এ এক নির্লজ্জ “স্ট্রিপটীজ”- ভিতরের বসন ক্রমশ উন্মোচিত হইতেছে। আশাকরি দিকে দিকে এইবার যথােচিত হাততালি পড়িবে।
মুজিবকে বাদ দিয়া পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসা- ধৃষ্টতারও একটা সীমা আছে। ব্যাপারটা শিবহীন যজ্ঞের মতন, ব্যাপারটা ডেনমার্কের রাজপুত্রকে বাদ দিয়া হ্যামলেট অভিনয়ের চেয়েও অবাস্তব । ইয়াহিয়ার হিসাবটা সম্ভবত এইঃ আওয়ামী লীগের জন দশ-বারাে সদস্যকে “গয়ারাম” করিয়া দিতে পারিলেই হইল, তাহা হইলেও জাতীয় পরিষদে মেজরিটি পূর্ববঙ্গ একেবারে মাইনরিটি। হত্যাবিলাসী দস্যু এখন হন্যে হইয়া খুঁজিয়া ফিরিতেছে, বিভীষণ মীরজাফর। এখনও জোটে নাই বলিয়াই তাহার এই চালাকি, এই নূতন চাল। ইয়াহিয়ার ভাষণেই মুজিব চরিত্র, মুজিবের ব্যক্তিত্ব আরাে একবার উজ্জ্বল আলােকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। তিনি যে কত বড় বাধা, কত বড় শক্তি, তাহার প্রমাণ তাঁহার প্রতি জঙ্গীশাহীর এখনও এত বিরূপতা। মুজিবকে হজম করা যাইবে না, দখলদারেরা সার কথা বুঝিয়াছে। এ এক আশ্চর্য কাকতালীয়তা যে, যেদিন ইয়াহিয়া তাহার বয়ান ফরমাইলেন সেই দিনই আমাদের লােকসভায় আরও একবার বাংলাদেশ লইয়া বক্তৃতার বান বহিয়া গেল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও একবার ভারতের নীতি বিশদ করিয়া বুঝাইলেন। কোনও পুতুল সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের দলছুট লােকদের লইয়া গোজামিলের ফয়সালা বাংলাদেশের জনগণ গ্রহণ করিবে না, তিনি তাহার এই বিশ্বাস স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিলেন। বাংলাদেশের মানুষ কী করিবেন না- করিবেন, সে তাঁহাদের ব্যাপার, কিন্তু আমরা কী স্থির। করিয়াছি তাহা অনুক্তই রহিয়া গেল। দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বােঝাপড়ার আগে উনাের দরবারে হাজির হওয়া বৃথা, বুঝিলাম। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলােচনারই বা ফলশ্রুতি কী? মার্কিন হাবভাব হাটের হাঁড়ির মতাে ফাটিয়া গিয়াছে, আর রাশিয়াকেও আজ পর্যন্ত ঠিক ঠিক বােঝা গেল না। স্ফিংস, মােনালিসার হাসি ইত্যাদির সঙ্গে আগামীকালের জাদুঘরে আরও একটি রহস্যময় দ্রষ্টব্য যুক্ত হইল বাংলাদেশের ব্যাপারে সােভিয়েট নীতি। ভারত সম্পর্কে ভারতেরই এক প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটু কড়া ভাষায় কটাক্ষ করিয়াছেন। আমরা নাকি দেশে দেশে ঘুরিয়া শুধু সচ্চরিত্রতার সাটিফিকেট কুড়াইয়াছি। এতটা বলা একটু বাড়াবাড়ি। ইহা ঠিক, নয়াদিল্লি বিলক্ষণ সংযমের পরিচয় দিয়াছে । ফল যে একেবারে মেলে নাই, তাহাও নয়। বিশ্বজনমত অন্তত আজ ভারতেরই অনুকূলে, নানা দেশের সরকার যতই না নিষ্ক্রিয় থাকুক। মল একেবারে না মিলিলে ঢাকা ঘুরিয়া আসিয়াও ব্রিটিশ এমপি বলিতেন না যে, পূর্ববঙ্গে গণহত্যা আজও তবু শুধু এই ফলটুকু হাতে লইয়া তুষ্ট থাকার অবকাশ আছে কি না ভাবিয়া দেখিতে হইবে।
ইয়াহিয়া প্রকাশ্যেই একটি দেশের নেতাদের স্বদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে আহ্বান জানাইয়াছেন। এ প্রায় সদরে কেঁড়া পিটিয়া গণিকা-সংগ্রহের আস্ফালন। রাষ্ট্রিক দুর্নীতি ইহার চেয়ে নীচে নামিতে পারে না। ভারতের প্রতি মুখ-ভ্যাংচানি লইয়া আমাদের নূতন কিছু বলার ছিল না। কেননা এই মুখবিকৃতি নূতন নহে ও পাকিস্তান যখনই বিপাকে পড়ে তখনই সব আক্রোশ ভারতমুখী খাতে চালাইয়া দেয়। কিন্তু ভারতের পক্ষে ইয়াহিয়ার ভাষণের একটি ভয়ঙ্কর তাৎপর্য আছে। এ দেশ নূতন করিয়া শরণার্থী স্রোতের জন্য প্রস্তুত হউক এবং যাহারা আসিয়াছেন তাহারাও ফিরিবেন না, এই কথাটা যেন মনে থাকে। মুজিব বা মুজিবের দলের সঙ্গে আপস না। হইলে ফিরিবার পথে কাটা পড়ে, কেননা ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে যে স্বস্তি তাহার আশা একেবারে মিলাইয়া যায় । কেহই ওখানে ফিরিয়া যাইতে সাহসী হইবেন না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাে একেবারেই নয়। | যুদ্ধের কথা বলা অনুচিত, যুদ্ধের কথা বলিতেছি না, কিন্তু প্রকারান্তরে ইয়াহিয়ার এই যে যুদ্ধ ঘােষণা, ইহার মােকাবিলা করার উপায় কী? হানাদারবাহিনীর সিপাহসালার একরকম বলিয়াই দিয়াছেন, শরণার্থীদের ফিরাইয়া লওয়ার অভিপ্রায় তাহার আদৌ নাই, বরং তাঁহার এই নৃতন নীতির অর্থ তিনি আরও লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এ দেশে চালান দিতে চান। যুদ্ধ করিব না, সুতরাং বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ববঙ্গের সংলগ্ন কয়েকটি জেলায় সুচিহ্নিত ভুখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেওয়া হউক-সি-পি-আই-প্রতিনিধির এই পরামর্শ বােধ হয় গ্রাহ্যের মধ্যেই আনা চলে না। তবু আত্মরক্ষার স্বার্থেই ভারতের নির্দিষ্ট কয়েকটি কর্তব্য রহিয়াছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি পিণ্ডিশাহীকে এতখানি সাহসী করিয়াছে। স্বীকৃতি দিয়া বাংলাদেশের। মুক্তিফৌজকেই সংগ্রামের জন্য আর একটু উপযুক্ত করিয়া দেওয়াও কি অসম্ভবঃ ইয়াহিয়াচক্র কিন্তু শােনা যায়। দুই মাসের মধ্যে নুতন দুই ডিভিশন খানসেনা তৈয়ার করিয়া ফেলিয়াছে। বাংলাদেশেও সংগ্রামী তরুণের অভাব নাই, আজ প্রয়ােজন সংগঠন, তাঁহাদের নেতৃত্বদান এবং পর্যাপ্ত সহায়তা। ইহার অন্যথায় ইয়াহিয়া খানেরা যাহা চান তাহাই ফলিবে। পাক প্রভুরা সিকি শতক ধরিয়া বাংলাদেশকে “ডিপেনডেন্সি” অর্থাৎ পরাধীন রাখিয়াছে, এইবার মাটির সন্তানদের মারিয়া কিংবা বিদায় দিয়া এই দেশটাকে “কলােনি করিয়া ছাড়িবে। বাংলাদেশে বাঙালীর স্থান নাই, ভবিতব্য কি ইহাই?
৩০ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা