You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.29 | প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ - সংগ্রামের নোটবুক

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

বাংলাদেশে ব্যাপক নরহত্যা শুরু হইবার দুই সপ্তাহ পরে পশ্চিম পাকিস্তানের আটজান সাংবাদিককে সেখানে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। ইয়াহিয়ার জল্লাদের সেই সাংবাদিকদের নির্দেশ দেয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়া এমনভাবে তাহাদের প্রতিবেদন লিখিতে হইবে, যাহাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে সেখানকার সাধারণ মানুষের মনে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। প্রতিবেদন পাঠ করিয়া যেন তাহাদের মনে হয় যে, বাংলাদেশের অবস্থা। একেবারে স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছে। আটজনের মধ্যে সাতজনই সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। হুকুম তামিল করেন নাই শুধু একজন। অ্যান্টনি মাসকারেনহাসও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লিখিয়াছেন, কিন্তু সেই বিবরণের কোথাও মিথ্যা কথা লিখিয়া নিজের ব্যক্তিত্বকে তিনি কলঙ্কিত করেন নাই। তিনি লন্ডনে চলিয়া যান। সেখানে ‘সানডে টাইমস’-এ তাঁহার যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়; গণহত্যাকারীদের যাবতীয় কুকীর্তি তাহাতে ফাস হইয়া গিয়াছে। মাসকারেনহাসের বিবরণ পড়িয়া স্পষ্টই বােঝা যায় যে, ইয়াহিয়ার জল্লাদেরা নরহত্যাকে বস্তুত একটা আমাদের খেলা করিয়া তুলিয়াছে। বিচার নাই, বিবেচনা নাই, প্রশ্ন করিয়া উত্তর শুনিবার ধৈর্য অবধি নাই, কাহারও সম্পর্কে সন্দেহ হইবামাত্র তাহারা গুলি চালায়। যে যত নিরীহ মানুষকে খুন করিতে পারে, তাহার তত গর্ব।

যে যত কষ্ট দিয়া নরহত্যা করিতে পারে, তাহার তত অহঙ্কার। ব্যাপার দেখিয়া মাসকারেনহাস স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলেন। চেহারা দেখিয়া যাহাদের মানুষ বলিয়াই মনে হয়, আচরণে তাহারা যে এতটা অমানবিক হইতে পারে, তাহা তিনি কল্পনাও করিতে পারেন নাই। দিগন্তবিস্তৃত হরিণ ধানক্ষেত, ইতস্তত কৃষ্ণচূড়ার রক্তাভা; দেখিয়া মনে হয়, ঈশ্বর যেন বাংলাদেশকে তাহার আপন হাতে সাজাইয়াছেন। অথচ, মাসকরেনহাস লিখিয়াছেন, সুন্দর সেই ভূখণ্ডের উপরে জঙ্গী-চক্র এক অকল্পনীয় কদর্যতার খেলা। চালাইতেছে। মানুষের মূর্তিতে একদল অমানুষ সেখানে বন্দুক-হাতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। স্বর্ণভূমিকে একেবারে নরক না করিয়া তাহাদের শান্তি নাই। মাসকারেনহাস স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলেন। অথচ ব্যাপারটা যে সত্যই খুব বিস্ময়কর, এমনও মনে হয়। । বস্তুত নিজেকে যিনি নাদিরশাহের বংশধর বলিয়া ভাবিতে ভালবাসেন, সেই ইয়াহিয়ার চেলাচামুণ্ডাদের আচরণে মানবিক কোনও গুণের পরিচয় মিলিলে সেইটাই বরং বিস্ময়ের ব্যাপার হইত। | ঐশ্বর্যময়ী দিল্লিকে একলা নাদির কীভাবে ভিখারী করিয়া দিয়াছিল, তাহা তাে কাহারও অজানা নয়। তাহার বংশধরেরাও ঠিক সেই ভাবেই আজ বাংলাদেশকে শুশান করিয়া দিতেছে। নাদির খুনী, ইহারাও খুনী; নাদির লুঠেরা, ইহারাও তাই। সুতরাং ঠিক নাদিরের মতাে, নরহত্যাকে ইহারা আনন্দের ব্যাপার ও লুণ্ঠনকে গৌরবের ব্যাপার বলিয়া জানিয়াছে । কিন্তু নাদিরের সঙ্গে তাহার বংশধরদের তুলনা নিশ্চয় এইখানে শেষ  হইতে পারে না। তুলনাটাকে আরও একটু আগাইয়া লওয়া যায়, এবং বলা যায় যে, ঠিক নাদিরেরই মতাে, ইহারাও একেবারে খােল-আনা পরদেশী লুঠেরা। এবং সেই কারণেই, নাদির যেমন ভারতের মাটিতে শিকড় গাড়িয়া বসিতে পারে নাই, বাংলাদেশ হইতে তাহার বংশধরদের বিদায়ও তেমনই অনিবার্য।

২৯ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা