You dont have javascript enabled! Please enable it!

পেন্টাগনের যুদ্ধবাজ পাখিগণ

ইহার পর আমেরিকা ভুলিয়াও যেন “গণতন্ত্র” শব্দটি মুখে না আনে। তাহার জাহাজগুলি যে দুনিয়ার।  ঘাটেঘাটে “মানবিক অধিকার” ইত্যাদি উদা উমূদা বুলি আর বড়াই ফিরি করিয়া না ফেরে। জ্বালানি হাতিয়ারে ঠাস মালচালানির কারবারটাই তাে দিব্য বলিয়াছে লােকের চোখে ধুলা দিতে তাহার উপর আবার। গণতান্ত্রিক ভণ্ডামির ত্রিপল চাপানাে কেন? অবশ্য বিশ্বের বাজারে তাহার হাবে-ভাবে আচরণে নৈতিক। লাজলজ্জা বলিতে আমেরিকার বিশেষ কিছু বাকী ছিল না। শেষ ডুমুর পাতাটিও এইবার খসিয়াছে।। জেফারসন- লিঙ্কনের আত্মা আমেরিকার আকাশে আজও ঘুরিয়া বেড়ায় কিনা জানি না। বেড়াইলেও তাহাদের উত্তরাধিকারীদের তাহারা চিনিতে পারিবেন না। হাসন নদীর মােহনায় “লিবার্টি”র মূর্তিখান জলে ঝাপ দিয়া লজ্জা নিবারণ করুক।বাংলাদেশের গণহত্যায় মার্কিন মুলুক ইয়াহিয়ার শরিক হইয়াছে। খুনিকে হাতিয়ার যে জোগায়, সেও একই রকম খুনি। পাকিস্তান এক রাষ্ট্র এ তত্ত্ব যদি খাটিও হয়, তবু সেখানেও মদমত্ত মাইনরিটি মেজরিটি ভাগের উপর বলাৎকার করিয়া চলিয়াছে। তাহাতেও মার্কিন পেন্টাগনের কর্তাদের চিত্তে এতটুকু দাগ পড়ে। নাই, কেননা তাহারা জানে পাকিস্তানের পশ্চিম-ভাগের জঙ্গীচক্রই জবরদস্ত, জিওপলিটিক বিচারে তাহাদের চোখে ওই মুলুকেরই মূল্য বেশি, তাহারা জানে রুটির কোন্ দিকটায় মাখন মাখানাে।  পাকিস্তানকে এই ভূভাগে ভারতের চেয়ে বেশি জোরদার করিবে বলিয়াই মার্কিন শাসকেরা পিন্ডিকরাচিকে নানা চুক্তির স্নেহভডারে বাঁধিয়াছে, কেন না অবাধ্য ভারত তাহার কথা শােনে নাই । বাধিয়াছে। রাশিয়ার দিকে আড়চোখে চাহিয়া। পিভি-পিকিং-পীরিতও সেই প্রেমের বাঁধন এতটুকুও আগা করিতে পারে। নাই । যাহা পারে, আমেরিকা অতএব পাকিস্তানের পায়ে ঢালিয়া উজাড় করিয়া দিয়াছে। ওই সব অস্ত্র-দাদনচুক্তি গণতন্ত্র বাচানাের জন্য, কমুনিজম ঠেকানাের জন্য এসব যুক্তি ধাপ্পা, প্রকান্ড বড় ভাঁওতা আমেরিকা জানে, তাহারই দেওয়া হাতিয়ার পাকিস্তান বারে বারে ব্যবহার করিয়াছে গণতন্ত্রী ভারতকে জব্দ করিতে। সেই হাতিয়ার এবার নিজ রাষ্ট্রের মানুষকে নিঃশেষে নিধন করার চমৎকার অভিযানে লাগিতেছে। “আর্মস । পলিসির এই স্বখ্যাত সলিলে ডুবিয়া মরা দেখিয়া আমেরিকা লজ্জায় অধােবদন হইতে পারিত। সে তাে । দূরের কথা সে নির্লজ্জভাবে পাপের জের পাপের ঘরে আরও জমা দিয়া টানিয়া চলিয়াছে।

পেন্টাগনের। বাজপাখিদেরই জয়-জয়কার।  কিন্তু আমরা যে মহাবিশ্বে মহাকাশে শান্তির পায়রাগুলি উড়াইয়া দিয়াছিলাম, তাহাদের খবর কী? “রাজনৈতিক সমাধানের খড়কুটাও মনে হয় তাহারা ঠোটে করিয়া আনিতে পারন নাই, কিছু যদি থাকিয়াও থাকে, তাহা হাওয়ায় খসিয়া পড়িয়া গিয়াছে। পাকিস্তানের ভিত্তি যে দ্বিজাতিতত্ত্ব, ব্রিটেনে সে কথা এখন আর কেহ বিশ্বাস করে না’; পাকিস্তান যে একজাতি, এই ধারণাও ওখানে সকলের টুটিয়া গিয়াছে, এ শুধুই তত্ত্বগত সানী। রাজনৈতিক সমাধান নহিলে ব্রিটেন পাকিস্তানকে সাহায্য দিবে না, এই ঘােষণার দামও খুব বেশি নহে- সে হেতু ব্রিটেন এখন শুধু গ্রেট তাহার নামমাত্র বিশেষণে। বস্তুত একে সে বুড়া ও অথর্ব। চূড়ান্ত বিশ্বাস। ঘাতকতা যাহা পিশাচদের শিরায় শিরায় আরও সুরা সিঞ্চন করিয়া চলিয়াছে। যে মাল পাকিস্তানের পথে, তাহার জন্য চুক্তি ২৫ মার্চের আগেকার- এই কৈফিয়ৎটাও ধােপে টেকে না। ইচ্ছা থাকিলে মাঝপথ হইতে। জাহাজগুলির মুখ ঘুরাইয়া লওয়া যায়- ১৯৬৫ সনে একবার লওয়া হইয়াছিল। আমেরিকার এই অবাধ কূটনৈতিক ব্যভিচারের জবাব ভারতের মন্ত্রি মহলে জানা আছে কি না জানি না। এই দু’মুখাে নীতিতে, এই দুই জনের দিকেই চোখ ঠারিয়া ঢলাঢলিতে ভুলিয়া থাকা আর সাজে না। সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ানে তেমন কোনও স্পষ্টতার চিহ্নও মিলিল না ।

তাহার জন্য দুঃখ হয়। দেশ-বিদেশে আবেদন আর নিবেদনের থালা বহিয়া বহিয়া নতশির হইয়া তিনি সবে দেশে ফিরিয়াছেন। কোথায় আত্মতুষ্টি’, ‘কোথায় আত্মশ্লাঘা’ এককালে যেমন “পঞ্চশীল”, হালে তেমনই আমাদের রাজনৈতিক সমাধান”-এর সর্বত্র দেদার খরিদ্দার জুটিয়াছে বলিয়া পরম পরিতােষ, তাহা নয় একেবারে মাটিতে পা দিতে-দিতেই সংবাদের মুষ্ট্যাঘাত! পঞ্চশীল আর রাজনৈতিক সমাধানের ভাগ্যে ইতর বিশেষ থাকিতেছে না। আবেদন আর নিবেদনের থালা আবার তুলিয়া ভেট দিতে হইতেছে- পেন্টাগন সর্দারদের বরাবরে ।।   পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাহাই করিয়াছে । দয়া করিয়া জাহাজ দুইটিকে থামান, ইহার বেশি মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে ভরসা পান নাই । ফ্রাঙ্ক কেলপ নামক মার্কিন যে মহােদয় সদ্য সরেজমিন মিশনে আসিয়াছেন তাহার সহিত অমায়িক মােলাকাৎ চলিয়াছে। আমেরিকা যদি রাজী না হয়, তবে কী করিব, তাহা ব্যক্ত হয় নাই। নৌপথে বা আকাশ পথে অবরােধ? সর্বনাশ ওসব কথা মুখেও আনিতে হয়না। তাহা হইলে নাকি লড়াইটা চড়াইয়ে। উঠিবে- যাহাকে বলে “একালেশন” । কিন্তু এই “একালেসানে”র ভয় পাকিস্তানের নাই, তাহার কীর্তি কেবল এই উপমহাদেশের সুখ-শান্তি নয়, গােটা অঞ্চলের শান্তি বিপন্ন করিতেছে, সর্দার স্বর্ণসিং নিজেই একথা স্বীকার করিয়াছেন। অভিধানে তাহার অর্থ বুঝি “এসকালেশন” নয়। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যখন আমাদের দুয়ারে আসিয়া। দাঁড়াইয়াছেন; এখনও ক্রমাগত বিপন্ন মানবতার করাঘাত শােনা যায়, আমাদের অর্থনীতি বিপর্যস্তপ্রায় তখনও আমরা তীব্র ভাষায় আমেরিকাকে বলিতে পারি নাই যে, তাহার আচরণ অমিত্রজোনিত, এমন কী বৈরিসুলভ। আমরা যেন শুধু টেলিফোনে ডায়াল ঘুরাইয়া বসিয়া আছি, অনিশ্চিত অপেক্ষা। কিন্তু ফল কী। মিলিবে তা নিশ্চিতই বলা যায় ? হাল ছাড়িয়া হতাশ গলায় বলিতে হইবে “নাে রিপ্লাই”।

২৫ জুন ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!