You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.17 | মিথ্যা শান্তি না সত্য যুদ্ধ | আনন্দবাজার পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মিথ্যা শান্তি, না সত্য যুদ্ধ | আনন্দবাজার পত্রিকা

বাংলাদেশ লইয়া যাহা বলিবার তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতে আমরা বাকী রাখি নাই । আরও স্পষ্ট করিয়া কয়েকটি কথা বলার দরকার দেখা দিয়াছে । কিন্তু আমরা শুধু বলিতেই পারি, করার সাধ্য নাই। করিতে যাহারা পারেন তাহারা এখনও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব, অথবা ভাষণে বাচনে স্বার্থক। একদিক হইতে “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাটির সঙ্গে কোথায় যে আমাদের রাষ্ট্রতরীটির মিল আছে। কাণ্ডারী শুধু নয়ন মেলিয়া হাসেন “কথা না বলে।” একেবারে যে বলেন না, তা নয়। বলেন, তবে সকলে অর্থ বুঝিয়া উঠিতে পারে না। যেমন “রাজনৈতিক সমাধান” কথাটি। যাক মানে লইয়া মাথা ঘামানাের দায় এক রকম চুকিয়া গিয়াছে। রাজনৈতিক মিটমাটের কথা যিনি বলিয়াছিলেন তিনি নিজেই আজ হাল ছাড়িয়া বলিতেছেন আশা বিশেষ নাই। “আমাদের উপর শরণার্থীদের বােঝা চাপাইয়া তােমাদেরও পরিত্রাণ নাই”। বৃহৎ শক্তিগুলির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই তথাকথিত হুঁশিয়ারির চেয়ে ঢের বেশি তাৎপর্যপূর্ণ তাহার এই সর্বশেষ স্বীকৃতি। রাজ্যসভার বিতর্কের উত্তর দিতে গিয়া কথাটা তিনি কবুল করিয়াছেন। গােড়ার দিকে ওখানে যখন যুদ্ধ, এখানে তখন আমরা যাহা পারি তাহাই করিয়াছি। শুভেচ্ছার ঢল তাে ছিলই উপরন্তু তর্কের তুফান দুটাইয়াছি। তখন রঙিন স্বপ্ন চোখে ভাসিতেছিল। ছিল অলীক ধারণা। শরণার্থীস্রোত যখন বহিতে শুরু করিয়াছে তখনই সেই ধারণা ঘােচে নাই। ভাবিয়াছি- সরকারও ভাবিয়াছেন- কয়দিনের মাত্র ব্যাপার, যাঁহারা আসিয়াছেন তাহারা ফিরিয়া যাইবেন। জোয়ারের পর ভাটা লাগিতে দেরি নাই।। ভাটা লাগিয়াছে, তবে অন্য অর্থে । আমাদের ভাবাবেগে। এখন আর তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে অন্য দলের ও খাদ মিশানাে চাই, এই সাচ্চা প্রগতিবাদী আবদার আর শােনা যায় না। কেননা ইহারাও বুঝিয়াছেন ওটা কালনেমির লঙ্কাভাগের মতাে শুনাইবে। আওয়ামী নেতৃত্বের নামে একটা বড় নালিশ, তাহাদের অনেকেই ওখানে নাই। কিন্তু থাকিলে কী হইত, থাকা সম্ভব ছিল কিনা, সেটা বুদ্ধিমানেরা কেহ খইয়া দেখেন নাই । থাকিলে কী আর হইত, ইয়াহিয়ার গুলির তালিকায় আরও কয়েকটি নাম যুক্ত হইত। বিশেষত বিশেষ করিয়া ইহারাই হইতেন লক্ষ্য। এখন ফিসফাস গুঞ্জন উঠিয়াছে, কোনও কোনও এলাকায় নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষ নাকি ফৌজী শাহীকে মানিয়া লইয়াছে। প্রচার বা মতলববাজ অপপ্রচর যাহাই হােক, টিটকারি দিতেছে কাহারা? দিতেছি। 

আমরা, এই বাংলায় যাহাদের বীরত্বের সীমা নাই, চোখের উপর খুন হইতে দেখিলেও চুপ করিয়া থাকি, অনেকেই মূষিকের মতাে বিবরের বসবাসী হইয়া রহিয়াছি। আসল কথাটা সমালােচকদের চোখ এড়াইয়া যায়। সেটা এই যে, একটি জাতির প্রতিনিধিত্ব করার পূর্ণ ফরমান আওয়ামী লীগেরই আছে। শঠতার শিকার না হইলে ইহারাও এতদিনে প্রকৃত মন্ত্রিরূপে ভার লইয়া বসিতেন। গায়ের জোরে একদল অত্যাচারী সেই অধিকার ছিনাইয়া লইয়াছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনমতের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর কতখানি? উত্তর নাই, যাচিয়া যাহারা আফিং খাইয়া বুদ, সাধিয়া অন্ধ, তাহাদের উত্তর দিবার উপায়ও নাই। কিন্তু আমাদের আছে । এ কথা বুঝিবার সময় আসিয়াছে যে, এ যুদ্ধ আর অন্য দেশের যুদ্ধ নহে। যুদ্ধ আমাদেরও। পাকিস্তান ছলে বলে কৌশলে আমাদের উপর চাপাইয়া দিয়াছে। শরণার্থীদের সংস্থান আমাদের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ, অনেক প্রকল্প-পরিকল্পনা শিকায় তুলিতে হইবে, অনেকগুলি বানচাল হইয়া যাইবে। এসব কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলিয়াছেন । আরােও বলিয়াছেন যে, “আমরা অনাহারে রহিয়াও উহাদের আহার জোগাইব।” পবিত্র সঙ্কল্প, উত্তম প্রস্তাব, তবু বিচার করিয়া দেখিতে হইবে, ইহার চেয়ে সহজ উপায়ে উহাদের স্বভূমে স্থিত করিয়া দেওয়ার উপায় আছে কি না। রাজ্য সভার বিতর্কে অনেক কথা সাফ-সাপ বলা হইয়া গিয়াছে। কেহ বলিয়াছেন গ্রাম্য ভাষায় যাহাকে বলে গাডড়া, ভারত সেই গাড়ােয় পড়িয়াছে। প্রশ্নটা এখন আর বাংলাদেশের উদ্ধার নয়, নিজেকে উদ্ধার। অঘােষিত লড়াই চালাইয়া যাইতেছে পাকিস্তান- আমাদেরই বিরুদ্ধে। ভারত কী করিবে? আমাদের দূতেরা দেশে দেশে মাধুকরী করিয়া ফিরিবেন, দেখিতেছি, আর কী? মাধুকরীতে বিশেষ ফল নাই হাতেহাতেই প্রমাণ পাইতেছি। বিশ্বের পাষাণ হৃদয় বিশেষ গলিতেছে না বা টলিতেছে না। হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব। ভাবসাব ক্রমশ উবিয়া যাইবে । লক্ষণ দেখা দিয়াছে- এখানে এবং হয়তাে ওখানেও। এখন এই বাস্তব সত্যটা স্বীকার করার সময় আসিয়াছে যে, এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের অনেকেরই ফেরার পথ রুদ্ধ। রুদ্ধই থাকিবে যতদিন না একটা বিহিত হয়। বিহিত করার ভার ভারতেরই উপর বর্তিয়াছে। অন্যদেশের দিকে তাকাইয়া লাভ নেই। ভারত-সােভিয়েট বিবৃতিতে এবার অন্য পন্থা অপরিহার্য, এই কথাটি দেখিয়া আহলাদে বিভাের হওয়ার বালচাপল্য। “বাঞ্ছনীয়” না বলিয়া, বলিয়াছে “আবশ্যিক” এই তাে? ওটা শুধু কথার কচকচি। ইহা দিয়া টীকাভাষ্য তৈয়ারি হইতে পারে, কাজ নয়।

সত্যকার যুদ্ধ, না মিথ্যা মেকী এই শান্তি এই প্রশ্নের মীমাংসার মুহূর্তে ভারত দোলাচল চিত্তে দ্বিধায় দুলিতেছে । দিনের পর দিন যায়, দেখিতে দেখিতে প্রায় তিনটি মাসও বহিয়া গেল, আজও আমাদের সিদ্ধান্ত কী, তাহা দেবতারাও জানেন না, কুতাে মনুষ্যাঃ। নিছক বাজপাখির চিৎকার বনাম শান্তি-পায়রার বকম ইহা নয় । যুদ্ধে জড়াইয়া পড়িতে ভারতের দ্বিধার কারণ সহজবােধ্য। পাছে পিণ্ডিশাহী রটায়, বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামটা আসলে ব-কলমে আমাদের লড়াই, আমরাই বাধাইয়াছি। বাধাই নাই, তবু রটনার হাত হইতে রেহাইও তাে নাই। তবে দ্বিধা কেন? এই দ্বিধা গােয়া, কচ্ছ কিংবা কাশ্মীরে তাে দেখা যায় নাই। ১৯৬৫ সনেও না। সব লজ্জা আসিয়া বাধা দিতেছে এবার। পূর্বাঞ্চলের ব্যাপার বলিয়াই কি? তাহা হইলেও বলিব, এই আঁচ এড়াইবার আশা ভারতের অন্য ভাগেরও নাই। কোনও কোনও রাজ্য। যতই শরণার্থীদের মুখের উপর “প্রবেশ নিষেধ” নােটিশখান লটকাইয়া রাখুক, তবু তাহাদেরও গা বাঁচানাের আশা নাই। বরং সমগ্র জাতির যেখানে সঙ্কট সেখানে সব অংশ মিলিয়া স্থির করুক ত্রাণের কোন্ পন্থা দ্রুততম, কোন্‌টা তুলনায় সহজসাধ্য । নিশ্চিত পথ কোনটি। যুদ্ধ ছেলেখেলা নয়, ইহা ঠিক, তাই বলিয়া জুজুর ভয়টা বাড়াইয়া দেখাও ভীরুতার পরাকাষ্ঠা। দেশের চরম বিপর্যয়ের দিনেও হাত গুটাইয়া যদি বসিয়া থাকিব; ক্লৈব, নৈফর্ম আর ভয়ের মন্ত্রজপ করিয়া চলিব, তবে জিজ্ঞাস্য “বিপুল ব্যয়ে, বিপুল একটি সেনাবাহিনীই বা পুষিয়া রাখিয়াছি কেন? দেশটা একেবারে অহিংস হইয়া গেলেই সব গােল চুকিত। প্রয়ােজনেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা যদি নাই রাখিব, তবে ফী ফী বৎসর প্রতিরক্ষা বাবদে বাজেটের বিল লাফাইয়া লাফাইয়া বাড়িয়াই বা চলিয়াছে কেন?

১৭ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা