You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.19 | কূটনৈতিক খেলার নূতন পর্যায় - সংগ্রামের নোটবুক

কূটনৈতিক খেলার নূতন পর্যায়

ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মীরা নাকি এবার ভারতে ফিরিতে পারিবেন। অন্তত ফিরিবার আশা উজ্জ্বল। গত মার্চ হইতেই কার্যত তাহারা বন্দী জীবন যাপন করিতেছেন। অবশ্য অন্য দেশের কূটনীতিকেরাও যে সেখানে খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করিতেছেন এমন নহে, সকলেই কোনও মত টিমটিমে একখানি প্রদীপ জ্বালাইয়া রাখিয়াছেন। কিন্তু ভারতীয় কূটনীতিকদের সে সুবিধাটুকুও দেওয়া হয় নাই, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ হইতেই পিভির একতরফা হুকুমে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের দুয়ারে তালা পড়িয়াছে। সেই সঙ্গে কলিকাতায় পাক ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসও আইনগত বন্ধ। কিন্তু পাকিস্তান কাহারও আইনের তােয়াক্কা রাখে নাই। ভিয়েনা-কেতা ইত্যাদি যাবতীয় আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া এক দিকে সে যেমন ঢাকার ভারতীয় কূটনীতিকদের জবরদস্তি করিয়া আটকাইয়া রাখিয়াছে, অন্যদিকে কলিকাতাও এক আজব কূটনৈতিক খেলা চালাইয়া যাইতেছে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার ব্যাপারে পাকিস্তান মনে হয় চীনের ছাত্র, কিন্তু রকম দেখিয়া মনে হইতেছে সে বুঝি গুরুকেও ছাড়াইয়া যায়। | পাকিস্তান যখন রণাঙ্গনে হাবুডুবু তখন তাহার পক্ষে এই কূটনৈতিক লড়াইয়ের পাঁয়তারা কেন, তাহা বােঝা মােটেই দুঃসাধ্য নয়। বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে তাহার প্রকাশ্য লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই কূটনৈতিক লড়াই এক দ্বিতীয় রণাঙ্গণ খােলার চেষ্টা মাত্র । অবশ্য আর এক বাসনা ছিল শ্রীহহাসেন আলি এবং তাঁহার সহচরদের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে চাপা দেওয়া। তবে আসল মতলব জল ঘােলা করিয়া বাংলাদেশের  ঘটনা হইতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্য দিকে সরানাে; অর্থাৎ নূতন কোনও পাক-ভারত সংকট সৃষ্টি। সে কারণেই আসরে হঠাৎ মেহেদি মাসুদ সাহেবের আবির্ভাব, এবং ঢাকার ঢাকনা খুলিতে নানা অবদারের অবতারণা। ফলে রুশ-বিমানের যাত্রা স্থগিত, সুইস প্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় বিরতি।

তৃতীয় পক্ষ হিসাবে সুইস প্রতিনিধিদের কিন্তু পাকিস্তানই ডাকিয়া আনিয়াছিল। পাকিস্তানের অনমনীয় ভাবের জন্যই তাহারা হাত গুটাইয়া লইয়াছিলেন। এক মাস পরে আবার তাঁহারা সালিশীতে রাজী হইয়াছেন। কারণ ভারত হাল ছাড়ে নাই। উপায়হীন ভারত উ-থানটের শরণাপন্ন হইয়াছিল। পাকিস্তানের পক্ষে এবার আর গড়িমসি সম্ভব হইল না। কারণ, এই ব্যাপারটাকে ইতিমধ্যেই সে তেতাে করিয়া ফেলিয়াছে, অন্যেরা সেটা গােপন রাখেন নাই । দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপুঞ্জকেও চটানাে ঠিক নয়। কেননা, ইরাবতী এবং বুড়িগঙ্গা দিয়া ইতিমধ্যে অনেক জল বহিয়া গিয়াছে। উত্থানটের প্রতিনিধিদের ছাড়পত্র দিতে হইতেছে। শুধু ইউ এন বা বিশ্বব্যাঙ্ক নয়, নানা দেশের প্রতিনিধিদল এখন পাকিস্তানে আসা যাওয়া করিতেছেন। “না” বলিবার উপায় নাই, তবে ধনে-প্রাণে পাকিস্তানের বিনাশ অনিবার্য। সুতরাং উথানটকে এ ব্যাপারে মােটেই বেগ পাইতে হয় নাই, সুইস প্রতিনিধিরাও নাকি সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন। বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিরা স্বেচ্ছায় এ দেশে আছেন, না জোর করিয়া তাহাদের আটক রাখা হইয়াছে- সে সম্পর্কে তাহারাই যাচাই করিয়া দেখিবেন। তবে ঘটনাস্থলে ভারত এবং পাক প্রতিনিধিরা হাজির থাকিবেন। সাধারণ বিচারে এই সুযােগটুকুও পাকিস্তানের প্রাপ্য নয়, কারণ শ্রীহহাসেন আলি এবং তাহার সহকর্মীরা এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ হইতে আর পাকিস্তানের নাগরিক নন, আনুগত্য তাহাদের বাংলাদেশের প্রতি। তৎকালে হইলে কোনও দেশের এই সাক্ষাৎকারের সুযােগ তাে মিলিতই না, পরন্তু হয়তাে বা ঢাকা দূতাবাসকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী। প্রেরিত হইত। তবু আমরা এ ব্যাপারে বাংলাদেশ-মিশনকে আবার ধৈর্যের পরীক্ষায় বসিতে অনুরােধ করিব। কেননা শুধু ঢাকা দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্য নয়, ভারত এবং বাংলাদেশ দুইয়ের স্বার্থেই মাসুদ সাহেবকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলিকাতা ছাড়া করা প্রয়ােজন।

১৯ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা