You dont have javascript enabled! Please enable it! রাশিয়ার ঘুম ভাঙে নাই - সংগ্রামের নোটবুক

রাশিয়ার ঘুম ভাঙে নাই

দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের মামলা….হাতব্যাগে পুরিয়া শ্রীস্বর্ণ সিং যখন বিশ্ব-পরিক্রমায় বাহির হন তখন। কেহই এমন আশা করেন নাই যে, তাহার হাতের ছোঁয়ায় রাজধানীতে রাজধানীতে হঠাৎ ঘুম ভাঙার পালা। শুরু হইয়া যাইবে। গত আড়াই মাসের ঘটনাবলি প্রমাণ করিয়াছে বিশ্বের মােড়লেরা জাগিয়া ঘুমাইতে বদ্ধপরিকর। জনমত যাহাই করুক, কোনও সরকার ইয়াহিয়া খানকে বেশি ঘাটাইতে রাজী নহেন, সকলেই কেতাদুরস্ত কূটনীতিক। এ ব্যাপারে মস্কো-লন্ডন-ওয়াশিংটনে ফারাক যৎসামান্য। কানাঘুষায় নানা গােপন চাপের কথা শােনা যায় বটে, কিন্তু শক্তিমানের যথার্থ চাপ যে পিণ্ডির শাসকদের পিঠে পড়ে নাই, বাংলার মাটিতে তাহাদের বিরামহীন বর্বরতাই তাহার ইঙ্গিত। তবু এটুকু আশী করা গিয়াছে শ্রীস্বর্ণ সিং এবং অন্যান্য ভারতীয় মন্ত্রীদের দৌত্য অন্তত একটা কাজ করিবে। বন্ধুরাষ্ট্রগুলির সহানুভূতি প্রকাশ্য হইবে। হয়তাে সংকটমােচনের কোন পথের নিশানাও মিলিবে। কেননা, সমস্যা আজ আর পূর্ববাংলার ভৌগলিক সীমানায় আবদ্ধ নাই, পাকিস্তানের “ঘরােয়া ব্যাপার আজ ভারতের ঘরােয়া ব্যাপারে পরিণত কিন্তু আজব ব্যাপার। এই, তা সত্ত্বেও শ্রীস্বর্ণ সিং প্রথম পদক্ষেপেই কার্যত ব্যর্থ। তিন দিন বৈঠক শেষে প্রকাশিত রুশ-ভারত যুক্ত ইস্তাহার বলিতেছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মস্কোয় কিছুই বেচিতে পারেন নাই। রাশিয়া এখনও দুই মাস। আগেকার সেই পদগর্ণি-রচিত পত্রখানাই ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখাইতেছে। সকলেই জানেন গত দুই মাসে বুড়িগঙ্গা এবং গঙ্গা-দুই নদীতেই বিস্তর জল বহিয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে। শান্তি ফেরে নাই। সেখানে এখনও আগুন। একদিকে ইয়াহিয়া খাঁর লুটেরা বাহিনীর মশালের আগুন, অন্য দিকে দুঃসাহসিক প্রতিরােধের আগুন।

সাড়ে সাত কোটি মানুষ এক কঠিন বাঁচা-মরার সংগ্রামে লিপ্ত। আশ্চর্য এই সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী, রাশিয়া এই গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। প্রধানমন্ত্রী। কোসিগিনের নির্বাচনী ভাষণেও নূতন কথা যৎসামান্য পাকিস্তানকে তিনি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন শরণার্থীদের দেশে ফিরাইয়া আনা প্রয়ােজন। ব্যস, ওই পর্যন্ত। যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানে গণহত্যার বিরুদ্ধে যেমন একটি কথাও নাই ঠিক তেমনই মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার কোনও প্রতিশ্রুতিও নাই। এটা রাশিয়ার মতাে কোনও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে স্বধর্মচ্যুতি কিনা সে বিচার তাত্ত্বিকেরা করিবেন। সত্য এই, সকলেই নিজ নিজ গার্হস্থ্যবুদ্ধিতে চালিত আদর্শবাদ একালে প্রায়শ উপকথা মাত্র। বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা মহলের লজ্জাকর অজ্ঞতার কথা আমরা শুনিয়াছি, শুনিয়াছি হৃদয়হীন ঔদাসীন্যের কথাও। স্মরণীয় মস্কো কংগ্রেস কাহিনী। স্মরণীয় জয়প্রকাশ দৈত্য। কিন্তু রুশ তরফে এই “সংযম”।  কোসিগিন এবং গ্রোমিকো রুশ-ভারত মৈত্রী সম্পর্কে অবশ্য কেহ কেহ বলিয়াছেন যুক্ত বিবৃতিতেও দুই দেশের মিত্রতা কি যাত্রার জয়গান, কিন্তু ভারত ইতিহাসের এক চরম সংকটে রাশিয়া ভারতকে সমবেদনা ছাড়া আর কিছু দিয়াছে বলিয়া মনে হয় না। আমাদের সৌভাগ্য, রুশ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করিয়াছেন ভারতে পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় লইয়াছে। খবরটা অবশ্য তাঁহারা পাইয়াছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট  হইতেই । তিনিই আগন্তুকদের মধ্যে কলেরার প্রকোপের কথাও উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে কথা বলিয়া রুশ নায়কদের ধারণা হইয়াছে, পরিস্থিতি “গুরুতর” ।

ভারতের সঙ্গে রাশিয়া একমত শরণার্থীদের স্রোত আটকানাে চাই। কিন্তু কোন্ ক্যানিয়ুট সে-ক্ষমতা রাখেন তা তাহার কোনও আভাস মেলে নাই। বলা। হইয়াছে- পূর্ব-বাংলার (যুক্ত বিবৃতিতে অবশ্য “পূর্ব পাকিস্তান”) এমন অবস্থা সৃষ্টি করিতে হইবে যাহাতে সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়া আসে এবং শরণাগতরা আবার ঘরে ফিরিতে পারেন। | দুই দেশ এ ব্যাপারে “রাজনৈতিক মীমাংসা” চাহে। অনেকেই তাহা চাহিয়াছেন। এমন কী ভুট্টো ইয়াহিয়া প্রমুখরাও। কিন্তু সেই মীমাংসার পথ কী সেই মূল প্রশ্নে দেখা যাইতেছে-রাশিয়াও অন্যদের মতােই নীরব। ব্রিটেনে তবু বিরােধী পক্ষের কেহ কেহ নিরাপত্তা পরিষদ ইত্যাদির দিকে আঙ্গুল তুলিয়াছেন, আমেরিকা নাকি মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব পাড়িয়াছেন। রাশিয়া কিন্তু কোনও নতুন ধরনের কোনও তাসখন্দ-প্রস্তাব করিতে পারে নাই। এক কথায় রুশনীতি বােধ হয় আগে যেখানে ছিল এখনও বােধহয় সেখানেই রহিয়াছে-অস্পষ্ট, অক্ষুট। হইতে পারে হাত খােলা রাখাই তাহাদের মতলব। তাহাতে কাহারও আপত্তি নাই। অস্বস্তিকর শুধু সে হাতের সঙ্গে এভাবে ভারতের হাত মেলানাে। কে কাহাকে “ভিটা দিয়াছেন জানি না, যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরের পরে একথা বােধহয় স্পষ্ট হইয়া গেল-বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নীতিও রাশিয়ার মতােই অস্পষ্ট, যদিও সংকট আমাদের ক্ষেত্রে রীতিমত বাস্তব। রাজনৈতিক সমাধান কোন্ পথে, সে কথা কি আমরাই বলিতে পারিয়াছি? “পাকিস্তান মৃত”-বাংলাদেশ সরকারের এই ঘােষণাকে কি আমরা গ্রহণ করিয়াছি? তবে আর রাশিয়াকে দোষ দিয়া লাভ কী, তাহারা দূরের দর্শক।

১২ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা