You dont have javascript enabled! Please enable it! সময় বহিয়া যাইতেছে - সংগ্রামের নোটবুক

সময় বহিয়া যাইতেছে

সেদিন প্রধানমন্ত্রী সরেজমিনে আসিয়া বলিয়াছেন, পরে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও কবুল করিলেন, এই বাংলার সাম্প্রতিক শরণাগত সমস্যা সত্যই “গুরুতর”। এটা একটা চমকপ্রদ আবিষ্কারই নয়, বরং পরিস্থিতি যে গুরুতর সেইটা ঠাহর করিতে করিতেই মাস-দুইকাল কাটিয়া গেল, এইটাই আশ্চর্য। মনে হয় কোথাও অবাস্তব আশাবাদ, কোথাও বাস্তব বােধের অভাব, দূরদর্শনের ঘাটতি, এইসব বাসা বাঁধিয়াছিল। ইহা ঠিক  দুই জনের কেহই অত্যুক্তি করেন নাই। একটা রাজ্যের ষােলােটা জেলার মধ্যে আটটারই প্রশাসন যদি শরণাগতদের চাপে ভাঙিয়া পড়ার উপক্রম হয়, তবে আর অত্যুক্তির অবকাশ বিশেষ থাকে না। মহামারী ইত্যাদির প্রসঙ্গ আপাতত নাই বা তুলিলাম।। | প্রধানমন্ত্রী আসিয়াছিলেন, ফিরিয়া গিয়াছেন। এই রাজ্য আগে যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। না, বরং ধসের পথে আরও খানিক নামিয়াছে। ধসিতে ধসিতে কোন্টা আগে সিবে, অর্থনীতি, না সমাজনীতি, সেটা। সঠিক বলা দুষ্কর। হয়তাে বা দুইটাই একসঙ্গে ধসিবে, অর্থাৎ ধসিতে এখনও যেটুকু বাকী আছে সেটুকুও।  টাকা ঢালিলেই এই সমস্যার কূল মিলিবে এ আশা দুরাশা। প্রথমত টাকা খরচ করারও সামর্থ্য এবং নৈপুণ্য চাই । আমলাতন্ত্র এই পরীক্ষায় সবসময়ে অনায়াসে তরিয়া যাইতে পারে না। তাহা ছাড়া আবার অর্থও অনেক সময় অনর্থের মূল হইয়া দাঁড়ায়। সর্বনাশ লইয়াও একদিকে অপটুতা, অন্যদিকে কপটতা ও ব্যবসাদারির নজিরের অভাব নাই। পুনরাবৃত্তি ঘটিতেই পারে। | একটি বিকল্প অবশ্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্যমকে সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে সঁপিয়া দেওয়া। যেমন যুদ্ধে, প্লাবনে, যাবতীয় আপকালে দেওয়া হয়। এও তাে প্লাবনই, শরণার্থী স্রোত। এও তাে যুদ্ধই পাকিস্তান যাহা আমাদের উপর চাপাইয়া দিয়াছে । আমরা সাধিয়া পটভূমিতে লড়িতে যাই নাই বটে, কিন্তু রেহাই তাে মিলিল না। আর এক প্রকারের যুদ্ধ-লক্ষ-নিযুত মানুষের আশ্রয় ও অন্নের ব্যবস্থা করা- সে যুদ্ধের দায় লইতেই হইয়াছে। এ যুদ্ধ মানবিক । জানিনা, সম্মুখ সমর ইহার চেয়ে প্রকাণ্ড, ইহার চেয়ে প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ লইয়া আসিত কি না? 

গােড়ায় মনঃস্থির করিতে সরকার বিস্তর সময় লইয়াছেন। ইয়াহিয়ার ধাপ্পায় তবে একা আওয়ামী লীগই। ভােলে নাই, আমাদের কূটনৈতিক আন্দাজ-বুদ্ধিতেও বেশ খানিকটা সরলতা ঢুকিয়া পড়িয়াছিল? নতুবা সরকার আগে হইতেই অন্তত শরণাগত-সমস্যার মােকাবিলা করিবার জন্য তৈয়ারি থাকিতেন। প্রথমদিকে। তাে ব্যাপারটাকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই। নবাগতদের সকলকে পশ্চিমবঙ্গে রাখা হইবে, এই নিশ্চিন্ত। বিশ্বাসের খােরাক মিলিয়াছিল কোন্‌ ভরসা হইতে? শরণার্থী স্রোত স্বাভাবিক। ওপাড় বাংলা হইতে বিপন্ন। বিতাড়িত মানুষেরা এই বাংলায় তাে আসিবেনই। সেখানে ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, শরণাগতদের বৃহদংশের ধর্মও এক, সেখানে তাঁহারা যে অঞ্চলের সঙ্গে নাড়ির বন্ধন কোনও রাজনৈতিক কাচি আজও ছিড়িতে পারে। নাই- সেই অঞ্চলের দিকে চলিয়া আসিবেন স্বাভাবিক টানে। বাঙালীকে বাঙালী না রাখিলে কে রাখিবে? | কিন্তু মুশকিল এই, এই বাংলার রাখার সাধ যত, সাধ্য ততটা নাই । পার্টিশনের কল্যাণে প্রায় প্রথম হইতেই ঠাই নাই; ঠাই নাই, ছােট এ তরী । অন্য রাজ্যে পাঠানাের কথা ভাবা হইয়াছে বটে, কিন্তু অনেক দেরিতে। সরকার হয়তাে ভাবিয়া থাকিবেন, অনিত্য এই সংসারে সবই অনিত্য এবং ক্ষণিক । ভাবিয়া থাকিবেন যে, পুনর্বাসন টেম্পােরারি হইলেও চলিবে। এখন বােধ হয় টের পাইয়াছেন যে, অস্থায়ী ব্যবস্থায় কুলাইবে না। ওই বাংলায় ফিরিয়া গিয়া বসবাস করার মতাে পরিবেশ চট করিয়া সৃষ্টি হইতেছে না। বিশেষ করিয়া সংখ্যালঘুদের তাে ফেরৎ পাঠানাের প্রশ্নই ওঠে না, সে ক্ষেত্রে আমাদের দায় দ্বিবিধ-মানবিক ও নৈতিক। পাকিস্তান তাহার মতলব হাসিল করিয়াছে শুধু শরণার্থীর বােঝা আমাদের ঘাড়ে চাপাইয়া হালকা হইয়া। যাইতেছে। শুধু আন্তর্জাতিক প্রচারের লড়াইয়ে এবার তেমন সুবিধা করিতে পারে নাই; এই যা। সেতাে। আমরাও পারি নাই গােয়ার ব্যাপারে, কিংবা কাশ্মীরের । তাহাতে কি আসে যায়? কাজ হাসিলই আসল কথা । যে-দিকটা বাস্তব, সেই দিকটাতে আমাদেরই এযাবৎ হার। বাস্তব-ভােগ আমরাই ভুগিতেছি।

প্রধানমন্ত্রীর একদিনের সফরেও কোনও লাগভেলকি লাগিল না, লাগা সম্ভবও ছিল না। খানিকটা কাজ যে পদ্ধতিতে হইতে পারিত, সরকার তাহার ধার-কাছ দিয়াও যান নাই, সে সময়ও পার হইয়া গিয়াছে। ধরা যাক, যশাের, খুলনা এবং কুষ্টিয়া- শুধু এইরকম গােটা কয়েক জেলাও যদি পাক-কবলিত হইত তাহা হইলেও পরিস্থিতি দাড়াইত ভিন্ন রকম  ওপারের শরণার্থীরা এপারে তাে আসিতেনই না, বরং পদ্মার ওই পারের উনূল মানুষেরাই স্বভূমেই পুনর্বাসনে স্বস্তি পাইতেন। আজ গতস্য শােচনা নাস্তি। আগামী কাল কী ঘটিবে তাহা লইয়াই কথা। অত্যাচারীর সঙ্গে আপস করিয়া শান্তি ক্রয় করা যায় না- ইতিহাসই তাহার সাক্ষী। চেম্বারলেন-দালাদিয়ে প্রমুখেরা হিটলারের সঙ্গে   তােষণনীতির কূটনীতি তাে কম করেন নাই । অস্ট্রিয়া গ্রাস, মেমেল, মিউনিখ, একের পর এক আগ্রাসনে চুপ। করিয়া ছিলেন। কিন্তু পরিণামে কী ঘটিয়াছে, সকলেরই জানা। সহনশীল রাজনৈতিক ধুরন্ধরেরাও শেষ পর্যন্ত চুপ করিয়া থাকিতে পারেন নাই। আমােঘ অনিবার্যতা তাহাদের টানিয়া নামাইয়াছে। একের শিক্ষা অপরের কাজে লাগেনা, ইতিহাসের এও একটা অদ্ভুত পরিহাস।  প্রধানমন্ত্রী সময় লইতেছেন, লউন, কোন্‌ ভরসায় তিনি আগামী অক্টোবরের মধ্যে সুরাহার আশা ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহার যুক্তি, তথ্য ইত্যাদি অবশ্যই তাহার জানা আছে? শারদ-প্রাতে অকস্মাৎ এই দুর্যোগের রাত পােহাইবে? তিনি সময় লইতেছেন, এদিকে সময় বহিয়া গিয়াছে- যাইতেছে। আরও বহিয়া গেলে ওই বাংলায় এই দেশ সম্পর্কে যে বিশ্বাস ও ভালবাসা জমা আছে, তাহা ক্রমে ক্রমে উবিয়া যাইবে। ঈশ্বর না। করুন, হয়তাে বা উবিয়া যাইবে ওই বাংলা হইতে আগত বিপন্ন মানবতার প্রতি এই বাংলার ভালবাসাও। আজিকার এই অনিশ্চিত-মন্ত্র সন্ধিপূজার ক্ষণে এই দুই ভালবাসাই সম্ভাব্য বলি হিসাবে কাঁপিতেছে।

৯ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা