পাকিস্তানের মরণ-ফাদ
নিজের নাক কাটিয়া পরের যাত্রা ভঙ্গ করার বিস্তর কাহিনী শােনা গিয়াছে বটে, কিন্তু আপনার গলা কাটিয়া অপরের আশাভঙ্গ করার প্রয়াস কখনও কেহ করিয়াছে কিনা সন্দেহ। ওই উদ্ভট কাজ করিয়া ইতিহাসে নূতন নজির খাড়া করিয়াছে পাকিস্তান। সেখানকার জঙ্গীশাহী জেদ ধরিয়াছে বাংলাদেশকে বিরাট একটা কবরখানায় পরিণত করিব, তবুও সেখানকার অধিবাসীদের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার মানিয়া লইব না তাহাতে প্রাণ যায় যদি তাে যাক । প্রাণ যে সত্যই যাইতে পারে, এতটা গােড়ায় জঙ্গীশাহী ভাবে নাই । এখন কিন্তু সত্যই তাহার জীবনসংশয়। অথচ তাহার চৈতন্য হইবার কোনও লক্ষণ চোখে পড়িতেছে না। বাংলাদেশে তাহার তাণ্ডব লীলা কেবল সে দেশেই অনর্থ বাধায় নাই, গােটা পাকিস্তানের ভিত্তিই টলাইয়া দিয়াছে। হিংসায় উন্মত্ত পাকিস্তানের তবু ভ্রুক্ষেপ নাই। জঙ্গীশাহী রক্ত ঝরাইতেছে বাংলাদেশে। তাহার ফলে কিন্তু তাহার নিজের শরীর হইতেছে যে নূতন রক্তসঞ্চার না করিলে তাহার প্রাণরক্ষা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিবে। সে রুধির শুধু মানুষের নয়, সে রুধির রাষ্ট্রেরও। বাংলাদেশের উপর জঙ্গীশাহী শাসন চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টায় প্রত্যহ প্রাণ দিতেছে পাকিস্তানী সেনারা। মুক্তিযােদ্ধার রক্তের সঙ্গে দখলদার ফেীজের রক্ত প্রত্যহই মিশিতেছে বাংলাদেশের মাটিতে। ওই অভিযান পরিচালনার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করিতে হইতেছে পাকিস্তানকে। মানুষের দেহ হইতে যে রক্ত অনবরত ঝরিতেছে তাহার প্রতিকার যদিও-বা করিতে পারা যায়। যদিও সেটা দিন দিন কঠিন হইয়া পড়িতেছে, ফৌজে যােগ দিতে আজ পাকিস্তানী তরুণেরা নারাজ-কিন্তু যে আর্থিক রক্তমােক্ষণ তিন মাস। ধরিয়া চলিতেছে তাহার ধাক্কা জঙ্গীশাহী কি সামলাইতে পারিবে?
যুদ্ধের অপর নাম ব্যয়বাহুল্য। এ যুগে ছােটখাটো একটা লড়াই চালাইতে কোটি কোটি টাকা লাগে। আমেরিকার মতাে অসাধারণ ধনী দেশও ভিয়েতনাম যুদ্ধ চালাইতে হিমসিম খাইয়া যাইতেছে, পাকিস্তান তাে কোন্ ছার! তাহার আছেই বা কী যে, সে নির্বিচারে মাসের পর মাস লড়াই চালাইয়া যাইবে? দৈনিক বাংলাদেশে মেঘনা-পদ্মায় পাকিস্তান ঢালিতেছে প্রায় এক কেটি টাকা। সে টাকার সবটা অন্তত নােট ছাপাইয়া সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কেননা বিদেশীদের কাছে সে নােটের কোনও মূল্যই নাই। তাহাদের চাহিদা মিটাইবার জন্য দরকার বৈদেশিক মুদ্রার। পাকিস্তানের তহবিলে সে মুদ্রার ঘাের অনটন। অথচ বৈদেশিক মুদ্রা না মিলিলে পাকিস্তানের অমন সাধের যুদ্ধ মাটি হইয়া যায়। গােলাবারুদ তাে পরের কথা, পেট্রোল কিনিতেই যে বিস্তর বৈদেশিক মুদ্রা লাগিয়া যাইতেছে। ধারে কারবারও চলিতেছে না। এমন কী সাধারণ বাণিজ্যিক রীতি অনুযায়ী যেটুকু ক্রেডিট পাওয়া যায় সেটুকু পাকিস্তানকে দিতে বিদেশি ব্যবসায়ীরা নারাজ। খােদ আমেরিকার বণিকেরা বলিতেছে- ফেল কড়ি, মাখ তেল, অন্যে পরে কা কথা! আমেরিকাই যদি পাকিস্তানকে অবিশ্বাস করে, জাপান কিংবা সুইজারল্যান্ড কেমন করিয়া বিশ্বাস করিবে? বাংলাদেশকে শায়েস্তা করিতে গিয়া পাকিস্তানের মজুত তহবিলে টান তাে পড়িয়াছেই, উপরন্ত সে। তহবিল ভরাইবার পথও বন্ধ। এ সেই সনাতন অতিলােভে যে হাঁস সােনার ডিম দেয় তাহাকেই মারিয়া ফেলার নির্বোধ প্রয়াস। পাকিস্তানের সােনার হাঁস ছিল বাংলাদেশ। সে যে ডিম পাড়িত সেটা ভােগে লাগিত বাঙালীদের নয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া বাংলাদেশ মাঠে মাঠে পাট ফলাইয়াছে, বাগিচায় বাগিচায় চা। জাহাজ জাহাজ ভরিয়া, সে চা, সে পাট কিংবা পাটজাত পণ্য, বিদেশে গিয়াছে আর তাহার মুনাফা ঘরে তুলিয়াছে পশ্চিম-পাকিস্তান। লড়াই এখন মুনাফার সেই উৎসমুখটি বন্ধ করিয়া দিয়াছে। আর দিন কতক যুদ্ধ চলিলে পাকিস্তানকে দেউলিয়া হইতে হইবে। তবে তাহার ভরসা-ব্রিটেন। বাংলাদেশের দুঃখে নাকে কাঁদিলেও পাকিস্তানকে দাক্ষিণ্য হইতে বঞ্চিত করিতে ব্রিটেন গররাজী। চৈনিক আনুকূল্য নাকি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানে পেীছিয়াছে। পশ্চিম-এশিয়ার বেরাদাররাও নাকি পাকিস্তানের ভিক্ষার ঝুলি ভরাইয়া তুলিতে উনুখ। কিন্তু রাই কুড়াইয়া বের আর কত হইবে? দরাজ হাতে সাহায্য দিয়াও পাকিস্তানকে আর্থিক ব্যাধিমুক্ত করিতে কি তাহার দোস্তরা পারিবে?
৫ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা