You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিবির হইতে শহরের দিকে

চৌবাচ্চায় যখন জল আর ধরে না তখন তাহা উপচাইয়া পড়ে। সেটাই নিয়ম। এই রাজ্যের সীমান্তে যে তিন। শত শরণার্থী-শিবির আকারে সেগুলি চৌবাচ্চাপ্রতিম হইলেও প্রথম হইতে প্রায় তাল পুকুরের কাজ চালাইয়া । আসিতেছে। এখন সে ক্ষমতা আর নাই; কারণ আগন্তুকদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই চল্লিশ লক্ষ পার হইয়া । গিয়াছে, এবং তাহার মধ্যে প্রায় তিরিশ লক্ষই পা রাখিয়াছেন এই রাজ্যের মাটিতে। ফলে শিবিরে আর্তনাদ, সীমান্তের জেলাগুলিতে ত্রাহি-ত্রাহি ডাক। শিবির হইতে দেশহারা মানুষ এবার দিশেহারার মতাে শহরের দিকে অভিযান চালাইয়াছেন। যে-শহরের লােক সংখ্যা ছিল সাড়ে চার লাখ, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফাপিয়া। তাহা দাড়াইয়াছে সাড়ে সাত লাখে। এ প্লাবনের মুখে বিধিবন্দোবস্ত সব টলটলায়মান। জলস্রোতের মতই। এই জনস্রোত কিন্তু সীমান্তের শহর গুলিতেই আটকাইয়া নাই বাঁচার স্বাভাবিক তাগিদেই আগন্তুকেরা এবার ধাওয়া করিয়াছেন রাজধানীর দিকে। বাংলাদেশ দেখিবার জন্য যাহারা কয়েক সপ্তাহ আগে সীমান্ত। অতিক্রমের জন্য ছটফট করিতেছিলেন, তাহারা এখন অনায়াসে কলকাতায় বসিয়াই ইয়াহিয়া খানের কীর্তিকে প্রত্যক্ষ করিতে পারেন। চল্লিশ হাজার শরণার্থীর আশ্রয় মিলিয়াছে দমদম বিমান বন্দরের অদূরে-সাহারায়। হাজার দশেক নাকি ঠাই পাইবেন লবণহ্রদে। বলা নিষ্প্রয়ােজন হিসাব চূড়ান্ত নয়, পাকিস্তানী জল্লাদেরা গৃহত্যাগীদের অভ্যর্থনা করার জন্য কুড়িটি জায়গায় তােরণ নির্মাণ করিলেও কেহ এখনও দ্বিরাগমনের কথা ভাবিতেছে না, আদৌ কতজন শেষ পর্যন্ত ফিরিবেন সেটাই কথা। প্রবাহ এখনও পশ্চিম মুখী। প্রতিদিন নবাগত এখনও গড়ে কমপক্ষে ষাট হাজার। এই জনতরঙ্গ কবে বন্ধ হইবে- সে গবেষণা অবান্তর কারণ, দেখা যাইতেছে কাহারও কোন গবেষণাই ঠিক নয়। সব মনগড়া হিসাব। আদিতে শােনা গিয়াছিল- ‘আগন্তুকদের সংখ্যা হাজারের শেষ অঙ্ক ছাড়াইবে এমন শােনা যাইতেছে এক কোটিতে পৌছাইলেও বিস্ময়ের কিছু নাই- দুই কোটিতে ঠেকাইলেই বা ঠেকায় কে?

সত্য এই ভারত এক সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায়। পাকিস্তানের ফৌজী-জমানা একাধিকবার সশস্ত্র বাহিনী পাঠাইয়া যাহা করিতে পারে নাই, এবার কপর্দকহীন অশ্রু-সর্বস্ব নরনারীকে সীমান্তের এপারে ঠেলিয়া। দিয়া তাহাই বােধহয় করিতে চলিয়াছে। সামনে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সম্ভবত রাজনৈতিক বিপর্যয়। বাংলাদেশের শরণার্থী বাজেটে ঠাই পাইয়াছেন, যােজনা-ভবনেও তাঁহাদের ছায়া। কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রীর হিসাব দশ লক্ষ আগন্তুকের জন্য ছয় মাসের খরচ কমপক্ষে ৫৩ কোটি টাকা। সকলের জন্য চাই-দুই শত। কোটি টাকা। বিস্তর কান্নাকাটি চেঁচামেচির পর বিশ্ব-বিবেক নাকি এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ নড়িয়াছে। হাঁকডাক মত, বর্ষণ সে তুলনায় এখন কিছুই নয়। এ পর্যন্ত মিলিয়াছে দশ কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ সমুদ্রে শিশিরবিন্দু। দেশে দেশে মন্ত্রীদের ধর্ণার ফলে দান-খয়রাতির পরিমাণ কিছু বাড়িবে কিনা ঈশ্বর জানেন। সন্দেহের কোনও অবকাশ না-রাখাই ভাল-আপাতত দায় আমাদের। এ দায় হইতে মুক্তির পথ কী জানিনা। বােধহয় সরকার নিজেও জানেন না। নীতির ব্যাপারে তাঁহারাও রিক্ত, দিন আনে দিন চলেন। প্রথমে শােনা গিয়াছিল আগন্তুকদের সীমান্তের কাছাকাছি রাখা হইবে, কারণ তাহারা অচিরেই ঘরে ফিরিবেন। পরে শােনা গেল, সীমান্তে বােঝা কমানাের জন্য কিছু শরণার্থীকে অন্যরাজ্যে পাঠানাে হইবে। কারণ অচিরে কোন রাজনৈতিক মীমাংসার পথ দেখা যাইতেছে না, অন্তত ছয়মাস তাহাদের খাদ্য এবং আশ্রয় জোগাইতে হইবে। এই “ছয় মাস সময়সীমারও কিন্তু কোন ব্যাখ্যা নাই। তবে কি ধরিয়া লওয়া যায় যে, তাহার পর ভারত নিজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার মীমাংসার দায়িত্ব লইবে? নাকি ‘বিশ্ব বিবেকের ঘুমের মেয়াদ ওই রকম? মীমাংসার সময় কিন্তু এখনই বহিয়া যাইতেছে। নিজেদের প্রয়ােজনে এগারাে লক্ষ কমনওয়েলথ নাগরিককে স্বদেশে ডাকিয়া লইয়া ব্রিটেন নির্লজ্জের মতাে কী কাণ্ডই না করিতেছে। অথচ ছয় সপ্তাহে প্রায় চল্লিশ লক্ষ আগন্তুকের বােঝা কাঁধে লইয়াও ভারত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়া চলিয়াছে। দৃশ্য দেখিয়া বিদেশি সাংবাদিকেরা পর্যন্ত বিস্ময় বিমূঢ়। আন্তর্জাতিক শালীনতার সে পরীক্ষায় সরকার সগৌরবে উত্তীর্ণ হউন, কিন্তু তাহাদের স্মরণ করিয়া দিতেছি, সঙ্গে সঙ্গে গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের পরীক্ষাতেও কিন্তু পাস হওয়া প্রয়ােজন। ইতিমধ্যেই নদীয়ায় ব্যাপক হারে কলেরা দেখা দিয়াছে। ইয়াহিয়ার গােলন্দাজদের যাঁহারা এড়াইয়া আসিয়াছিলেন মৃত্যু তাঁহাদের পিছু ফিরিতেছে। শিবিরের বিধিব্যবস্থা অবিলম্বে আরও উন্নত করা প্রয়ােজন। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বৃহৎ ক্যাম্প-তাহাই বা কত দূরে? মােটকথা, সীমান্ত হইতে শহরে গণ-অভিযান বন্ধ করা চাই। এবং তাহা হইতে পারে এক মাত্র আরও সুপরিচালিত শিবিরপত্তনের মাধ্যমেই। মন্বন্তরের ইতবৃত্ত সাক্ষী শহর হাতছানি দেয় বটে, কিন্তু ক্ষুধার্ত, অসুস্থ মানুষের কাছে শহর মরীচিকা মাত্র।

৩ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!