You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.17 | সামান্য কৃতিত্ব নহে - সংগ্রামের নোটবুক

সামান্য কৃতিত্ব নহে

পূর্ববঙ্গের মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা পদ্ধতিতে পাক-ফৌজের উপর আক্রমণ চালাইতেছে। ঘটনার প্রাত্যাহিক বার্তা বিবরণ দেশবাসীর কাছে পরিবেশন করিতেছে বেতার ও সংবাদপত্র। বলিতে হয়, ঘটনার সংবাদ শুনিতে দেশবাসীর চিন্তা কৌতূহল অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। অথচ বাস্তব সত্য এই যে, দুই মাস আগে এই ধরনের ঘটনার সম্ভাবনা কেহ কল্পনাও করে নাই। যাহা অকল্পনীয় ছিল তাহাই বাস্তব রূপ গ্রহণ করিয়াছে ও ঘটনায় সত্য হইয়া দেখা দিয়াছে। আধুনিক কালের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও কোনদিন মুক্ত সংগ্রামের আবেগ গেরিলা পদ্ধতির সামরিক তৎপরতার রূপ লইয়া দেখা দেয় নাই। আধুনিক কালে এই প্রথম পূর্ব বাংলার জীবনের ঘটনা হইয়া ইহা দেখা দিয়াছে। যে ঐতিহ্য ছিল না, পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামীরা সেই ঐতিহ্য সে মুহূর্তের চকিত বিস্ময়ের মত সহসা সৃষ্টি করিয়াছে। বিশেষজ্ঞ সমালােচক যাহাই ধারণা করুন না কেন, পূর্ববাঙলার মুক্তিসংগ্রামীরা গেরিলা সংগঠন ও সক্রিয় তৎপরতা একটি অভিনব সফলতার ঘটনা। কোন দেশের সামরিক কৃতিত্বের ইতিবৃত্তে ঘটনার এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যাইবে না যে, একমাসের মধ্যে। কোন গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ সংগ্রামীর দল, নিরস্ত্র ও সামান্য সশস্ত্র জনতা দ্রুত সংগঠন সম্ভব করিয়া শত্রর। উন্নত অস্ত্রবলসম্বলিত বিপুল সংখ্যক বাহিনীকে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করিয়া পর্যদস্ত করিতেছে। সংবাদ প্রচারিত বিবরণ যদি বাছবিচার করিয়া ছােট করিয়া লওয়াও হয়, তবু তাহা এই সত্যটি স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দিবে যে, ইয়াহিয়ার পাঁচ ডিভিসন সৈন্য তাহাদের ট্যাঙ্ক আর্টিলারী ও প্রচণ্ড অনলবর্ষী শক্তি লইয়াও পূর্ব বাংলার সামান্য সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামীর গেরিলাদিগের আক্রমণে পর্যদুস্ত হইতেছে।

মহারাষ্ট্র পুরাণের লেখক রামেশ্বর ভট্টাচার্য রঘুজীর মারাঠ সওয়ার-সৈন্যের নিদারুণ আক্রমণ-শক্তির পরিচয় বুঝাইতে গিয়া বলিয়াছেন- তাহারা ‘পলকে প্রলয়’ হানিয়া থাকে। মােগল ঔরঙ্গজেব একদিন মারাঠা শিবাজীকে ‘পার্বত্য মুষিক’ আখ্যা দিয়া তুচ্ছ করিয়াছিলেন। তিনি চিঠিপত্রে ও নির্দেশে শিবাজীর নামটিকে তুচ্ছ করিয়া শিবা’ বলিয়া লিখিতেন। কিন্তু ইতিহাসের ঘটনা প্রমাণিত করিয়া দিয়াছে যে, শিবাজীর বাহিনী যাহারা গেরিলা পদ্ধতির সংগ্রাম চালাইয়া মােগল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করিত তাহারা মােগলের মসনদকে টলাইয়া দিয়াছিল।  নাৎসীবলিত ফ্রান্সের জনপ্রতিরােধ গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াও তেমন-কিছু কৃতিত্ব দেখাইতে পারে নাই । দখলদার নাৎসী বাহিনীর পক্ষে সেই ফরাসীয় জনপ্রতিরােধ দিনের খোঁচার মতাে আঘাতের চেয়ে বড় কোন আঘাত হয় নাই। কিন্তু ইহাই মুক্তিসংগ্রামীর গেরিলা পদ্ধতির সামরিক তৎপরতার ইতিহাসে একমাত্র অথবা চরম পরিণামের দৃষ্টান্ত নহে। আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামীরা দেখাইয়া দিয়াছে যে, গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণে লম্বা চওড়া বাহিনীর হৃদৃপিণ্ড ফাটিয়া যায়। ভিয়েনামের যুদ্ধ ও প্রাত্যহিক ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত করিতেছে যে গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণ দখলদার বাহিনীর জবরদস্ত স্থিতি ও গতির সর্বনাশ সম্ভব করিতে পারে। হ্যা, পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামী গেরিলারা যদি যথেষ্ট, অস্ত্রসম্বল না হয়, তবে ইয়াহিয়ার পাঁচ ডিভিসন হিংস্রপ্রাণীর অত্যাচার প্রশমিত হইবে না। কিন্তু যদি পায়, যদি পূর্ববাংলার মুক্তিসংগ্রামী গেরিলারা উন্নত অস্ত্রের সম্বল সংগ্রহ করিতে পারে, তবে তাহারাও ‘পলকে প্রলয়’ হানিতে পারিবে।

১৭ মে, ১০৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা