You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.18 | জঙ্গীশাহীর কুটিল চক্রান্ত - সংগ্রামের নোটবুক

জঙ্গীশাহীর কুটিল চক্রান্ত

প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করিয়াছেন, জনাকীর্ণ এই দেশের খাদ্য ও অর্থের অভাব আছে, কিন্তু অনুকম্পা কী করুণার নাই। তাই পাকিস্তানী অত্যাচারে নিপীড়িত বাংলাদেশের ছিন্নমূল নরনারীদের ভারতবর্ষে আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি দেশবাসীর পক্ষ হইতে দিয়াছেন। দায়িত্বটা কোনও দিক দিয়াই লঘু নয়। প্রচুর। অর্থের ও খাদ্যের প্রয়ােজন সুষ্ঠুভাবে ওই দায়িত্ব পালন করিতে গেলে। কোথা হইতে সে অর্থ ও খাদ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী আসিবে, সে তত্ত্ব না ভাবিয়াই ভারত সরকার মানবিকতার আহ্বানে সাড়া দিয়াছেন, সীমান্তের অদূরে শরণার্থীশিবির তৈয়ারি হইয়া গিয়াছে। বর্ষার জলধারার মতাে অবিশ্রান্ত শরণার্থীর দল পিতৃপিতামহের বাস্তু ত্যাগ করিয়া নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্তের এপারে ছুটিয়া আসিতেছেন। তাহাদের বিমুখ করিবে এমন পাষাণ হৃদয় ভারতবর্ষে কাহার আছে? তবুও ভােলা যায় না সাধ্য আমাদের সীমিত। ভােলা যায় না শরণার্থীদের বাস্তহারা ঘরছাড়া করিয়াছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়- হৃদয়হীন মানুষের বর্বরতা, কুটিল রাজনীতিকের কুরতা। দেখিয়া-শুনিয়া মনে হইতেছে পাকিস্তান একঢিলে দুই পাখি মারিতে চাহিতেছে। তাহাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের মেরুদণ্ড ভাঙিয়া দিয়া নূতন রাষ্ট্রকে সূতিকাগারেই বিনাশ করা। ইয়াহিয়া খাঁর নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী যুগপৎ বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী মিত্ররাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যে পুষ্ট হইয়া বাংলাদেশের তাবৎ নগর লণ্ডভণ্ড করিয়া ফেলিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম অঞ্চলেও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করার প্রয়াস পাইতেছে।

স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের নাগরিকদের কঠোর শিক্ষা দেওয়াই কিন্তু জঙ্গীশাহীর একমাত্র সংকল্প নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতবর্ষকে বিপাকে ফেলার বাসনাও তাহার সমান তীব্র। পাকিস্তানী বাহিনী তার রণকৌশল এমনভাবে বিন্যস্ত করিয়াছে যে ভারতবর্ষ, বিধস্ত না হউক, ব্ৰিত ও বিড়ম্বিত হয়। | সেই জন্যই ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলে নিদারুণ অত্যাচার শুরু করিয়াছে জঙ্গীশাহীর সৈন্যদল। সে সব অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে দুইটি পথই খােলা আছে- এক নীরবে মৃত্যুবরণ করা, নয়তাে বাস্তু ছাড়িয়া ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করা। দ্বিতীয় পথটিই তারা নিরুপায় হইয়া বাছিয়া লইয়াছে। এমনটি যে হইবে সেটা পাকিস্তানও অনুমান করিয়াছিলাে। পরম উৎসাহে তাহারা তাহাদের নৃশংস নির্যাতন চালাইয়া যাইতেছে সীমান্ত অঞ্চলে যাহাতে শরণার্থীর প্লাবনে ভারতবর্ষ ভাসিয়া যায়। এদেশ যদি আতঙ্কিত হইয়া সীমান্ত বন্ধ করিয়া দিত তাহা হইলে পাকিস্তানের আনন্দ ষােল কলা পূর্ণ হইত, তাহার হীন চক্রান্ত সার্থকতা লাভ করিত। ভারতবর্ষ কিন্তু তাহার চাতুরীতে বিভ্রান্ত হয় নাই- শরণার্থী-সমাগমে বাধার সৃষ্টি করা দূরে। থাকুক, তাহাদের আশ্রয়দানের যথাসাধ্য আয়ােজন করিয়াছে। সে আয়ােজনের ত্রুটি নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আন্তরিকতা ও সহৃদয়তা সে ত্রুটি সারিয়া লইয়াছে। পূর্ণ আরাম শরণার্থীদের দেওয়া হয়তাে সম্ভব নয়, তবে আশ্রয় শিবিরে স্বস্তি অন্তত তাহারা পাইবে।।

কিন্তু পাকিস্তান কী এত অনাচার ও যথেচ্ছাচার করিয়াও পার পাইয়া যাইবে? শরণার্থীদের ভারতবর্ষ কোনও মতেই বঞ্চিত করিবে না। কিন্তু তাহাদের দায় একাকী এদেশ কেন বহন করিবে? দায়টা নিঃসন্দেহে সমগ্র মানব-সমাজের। প্রত্যেকটি দেশেরই এ ব্যাপারে দায়িত্ব আছে। প্রত্যেকটি দেশেরই উচিত শরণার্থীদের সাহায্যে অগ্রসর হইয়া আসা। কিন্তু দায়তাে সর্বাপেক্ষা বেশি পাকিস্তানের। লক্ষ লক্ষ লােক গৃহহারা হইয়াছে তাহারই নির্মম অত্যাচারে । তাহার মূল্য সে কিছুই দিবে না? যতদিন না বাংলাদেশে সে এমন অবস্থার সৃষ্টি করিতে পারে যাহাতে শরণার্থীরা নিজভূমে পরবাসী হইয়া আর না থাকে নিজেদের মর্যাদা আদর্শ বজায় রাখিয়া স্বচ্ছন্দে দিন যাপন করিতে পারে- ততদিন তাহাদের ভারতপ্রবাসের সম্পূর্ণ ব্যয় তাহাকেই বহন করিতে হইবে। স্বেচ্ছায় অবশ্য সে কাজ পাকিস্তান করিবে না। তাহার অমানুষিক অত্যাচারের খেসারত তাহার নিকট হইতে জোর করিয়া আদায় করতে হইবে। পাকিস্তানকে ওই দাবি ভারত সরকারের পক্ষ হইতে জানাইয়া অবশ্য দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু শুধু কথায় তো পাকিস্তানকে বাগ মানানাে যাইবে নাতাহার জন্য প্রয়ােজন ভিন্ন উপায় । সে উপায় অবলম্বনের জন্য ভারত সরকারকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে।

১৮ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা