নিরপেক্ষতার ভান
মার্কিন সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে ধন্যবাদ, তিনি অন্তত বাংলাদেশের ব্যাপারে আমেরিকার নিরপেক্ষতার ভণ্ডামিটা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন। পাকিস্তানে আমেরিকা কম্মিণকালেও নিরপেক্ষ ছিল না, এখনও নাই। মার্কিন সাহায্য না মিলিলে পাকিস্তান ভাঙিয়া পড়িত অনেক দিন আগেই। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আজও লড়িতেছে মার্কিনী খুঁটার জোরে, তাহাদের বলভরসা আমেরিকা তাে বটেই, যুদ্ধের সরঞ্জামও যােগাইতেছে সেই-ই। কাজেই বাংলাদেশের ঘটনা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার তাহাতে হস্তক্ষেপ করা আমেরিকার পক্ষে অসঙ্গত এটা একটা যুক্তিই নয়, সত্য গােপন করার একটা অছিলা মাত্র। উদ্দেশ্য দেশের লােকের চোখে ধূলা দেওয়া, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বেশ জড়াইয়া পড়িয়াছে সে অপ্রিয় সত্যতা চাপা দেওয়ার অপচেষ্টা। বাংলাদেশের গণহত্যার পাপ মুখ্যত পাকিস্তানের হইলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাহার এক বড় অংশীদার। যে ট্যাঙ্ক বাংলাদেশের নগরে নগরে ত্রাসের সৃষ্টি করিতেছে, যে সেবার জেট আকাশ হইতে হিংস্র আক্রমণ চালাইয়া লক্ষ লক্ষ নরনারীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটাইতেছে, যে গুলিগােলা বেয়নেট নির্মমভাবে নিরস্ত্র নাগরিককে পশুর মতাে হত্যা করিতেছে, সে সবই তাে মার্কিন অনুগ্রহের দান। আমেরিকা যদি পরম স্নেহে অতি-আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র লিয়া অলরের দুলাল পাকিস্তানকে না সাজাইত তাহা হইলে বাংলাদেশে যে পৈশাচিক তাব চলিতেছে সেটা কী চলিতে পারিত। আমেরিকা কেবল সামরিক সরঞ্জাম তুলিয়া দেয় নাই, তাহার পকেট বােঝাই করিয়া ডলার দিয়াছে । ভাড়ার উপচাইয়া খাবার। এখন বাংলাদেশে যে কাণ্ডটা সে করিতেছে সেটা নিতান্তই তাহার ঘরের ব্যাপার বলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে কেন? সে ঘরে নাক তাে আমেরিকা পাকিস্তানের আঁতুড় ঘরেই ঢােকাইয়াছে ।
আমেরিকা যদি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর খুঁড়িতে চায় তাহা হইলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে বুঝিতে হইবে পাকিস্তানী দস্যুদের-প্রশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আমেরিকা নির্লিপ্ততার ভেক ধরিয়াছে। কিন্তু দুইদশজন রাজনীতিক কিংবা আমলা যা চান দেশসুদ্ধ লােক কী তাহাতে সায় দিবে? দেখা যাইতেছে এডওয়ার্ড কেনেডি সেটা পারেন নাই। পারেন নাই আরও অনেক মার্কিন রাজনীতিকও বুদ্ধিজীবী । তাহারা চান বাংলাদেশের বুকে ইয়াহিয়া খাঁর জঙ্গীশাহীর উন্মত্ত নৃত্যের অবসান। সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের দুর্দশার অন্ত । তাহার উপক্রমণিকা হইবে পাকিস্তানে সর্বপ্রকার মার্কিন আনুকূল্য বন্ধ করা। মার্কিন হাতিয়ার না পাইলে পাকিস্তান লড়াই চালাইবে কিসের জোরে? বাংলাদেশে হানা দিতে গিয়া প্রত্যহ তাহার যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হইতেছে সেটা কোথা হইতে আসিবে যদি মার্কিন বদান্যতার উৎসমুখ রুদ্ধ হইয়া যায়? নিজের কলঙ্ক যদি আমেরিকা ঘুচাইতে চায় তাহা হইলে তাহাকে আপাতত পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখিতে হইবে। পাকিস্তান তখন যদি নিরুপায় হইয়া বাংলাদেশ ছাড়িয়া যায় তাহা হইলে জয় হইবে গণতন্ত্রের। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ শাসনের সুযােগ পাইবেন। গণতন্ত্রী আমেরিকার তাহাই তাে কাম্য হওয়া উচিত। কথা উঠিয়াছে বিপর্যস্ত বাংলদেশে ত্রাণকার্যের দায়িত্ব চাপাইয়া দেওয়া হইবে পাকিস্তানের উপর । এতাে ডাইনির হাতে সন্তান সমর্পণ। ত্রাণ সামগ্রী লইতে পাকিস্তান হয়তাে আপত্তি করিবে না। কিন্তু সেটা পশ্চিমের ভােগে লাগিবে, বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশে ত্রাণকার্যের দায়িত্ব লইতে হইবে আন্তর্জাতিক কোন সংস্থাকে । পুরাতন কোনও সংস্থা যদি সে কাজ করিতে না পারে তাহার জন্য নূতন একটা সংস্থা না হয় গঠন করা হউক, কিন্তু পাকিস্তান নৈব নৈব চ। আজ না হয় বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলিতেছে সে কথা সে অস্বীকার করিতে চায়। কিন্তু যখন পাকিস্তানের সংহতি খণ্ডিত হয় নাই তখন ঘুণী ও বন্যার পর কোন সাহায্য সে বাংলাদেশে দিয়াছে, লােকের কষ্ট লাঘবের জন্য কোন ব্যবস্থা করিয়াছে? বিপন্ন বাংলাদেশকে চরম বিপর্যয়ের মুখ হইতে বাঁচাইতে গেলে আগেই তাহাকে পাকিস্তানী নেকড়ের কবল হইতে উদ্ধার করিতে হইবে।
১৫ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা