শকুনির উল্লাস
নরমাংসে উদর পূর্ণ করিয়া শকুনিরা আর নড়িতে পারিতেছে না; ভােজন সুখে তৃপ্ত হইয়া তাহাদের দেহ বড়ই ভারী হইয়া গিয়াছে। তাহারা বুড়িগঙ্গার তীরে সারি দিয়া বসিয়া আছে। ঢাকাতে গিয়া এই দৃশ্য দেখিয়াছেন বিদেশী সাংবাদিক। তাঁহার মন্তব্যঃ শকুনিরা তাদের ভােজের জন্য সম্ভবত পাঁচ লক্ষেরও বেশি মৃতদেহ পাইয়াছে। পঁচিশে মার্চ হইতে শুরু করিয়া পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে পূর্ববাংলার জীবনের উপর রাজনৈতিক জিঘাংসার এক বীভৎস আক্রমণে পাঁচ লক্ষের বেশি মানুষের প্রাণ হারাইয়াছে। অন্য হিসেবে নিহতের সংখ্যা দশ লক্ষ বলিয়া ধারণা করা হইয়াছে। শকুনিরা তৃপ্ত হইলেও পাকিস্তানী ইয়াহিয়ার প্রাণ তৃপ্ত হইতে পারিয়াছে কী? প্রতিদিনের ঘটনার সংবাদ প্রমাণিত করিতেছে যে, পাকিস্তানী ইয়াহিয়ার প্রাণের শােণিত পিপাসা এখনও তৃপ্ত হইতে পারে নাই। খুনী পাক-ফৌজ নরহত্যা করিয়াই চলিয়াছে । একদফা নরহত্যার রক্তমাখা কাদা শুকাইতে-না-শুকাইতে নূতন হত্যার তপ্ত রুধির পূর্ব বাংলার ও জনপদের মাটি ভিজাইয়া দিতেছে। অতীতের হুন হিংসার সেই চণ্ড দূত আটিলাও আজিকার ইয়াহিয়ার মতাে নরশােণিতের বন্যা বহাইতে পারে নাই। ভবিষ্যতের শিল্পী যখন অধমতম বর্বরের মুখাবয়ব কল্পনা করিবে, তখন এই ইয়াহিয়ার মুখের চেহারাটা তাহার মনে পড়িবে। ছবিতে দেখা যাইবে বর্বর ইয়াহিয়ার মাথার উপর একটি শকুনি মুকুটের মতাে দাঁড়াইয়া আছে। শকুনিরা মৃতদেহের মাংস খায়। তাহাদের ক্ষুধার তাড়না ও তৃপ্তির উল্লাস সকাল হইতে শুরু হয় এবং সন্ধ্যা হইতেই থামিয়া যায় ।
কিন্তু পাকিস্তানী ইয়াহিয়ার ও তাহার জহাদ ফৌজের কাছে দস্যুর কাছে দিন রাত্রির কোন প্রভেদের বিচার নাই। শকুনিরা যখন ঘুমাইয়া পড়ে, নেকড়ে পাক-ফৌজ তখনও মানুষের ঘরে ঘরে প্রবেশ করিয়া জীবন্ত নরদেহ সন্ধান করে । কল্পনা করিতে অসুবিধা নাই, পূর্ব বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের নিশাচর জন্তু-ফৌজ কীভাবে মানুষ ও মনুষ্যত্বকে দংশন করিয়া ছিন্নভিন্ন করিতেছে। শরণার্থী নরনারীদের অভিজ্ঞতার বিবৃতি হইতে নৈশ বিভীষিকার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা বুড়িগঙ্গার তীরের শকুনির সমারােহের চেয়ে শতগুণ বেশি বিভৎস। দ্রিাহীন বৃদ্ধ আঙ্গিনাতে পায়ের শব্দ শুনিয়াই বুঝিয়া ফেলে, প্রেতের দল আসিয়াছে হত্যা করিয়া ও ঘরে আগুন লাগাইয়া প্রেতের দল চলিয়া যায়। প্রেতের সহযােগী জাতিদ্রোহী ও দেশদ্রোহীর দলও আসে। লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও গৃহদাহের জঘন্য মত্ততা চরিতার্থ করিয়া তাহারা চলিয়া যায়। দূরের অন্ধকারে যে আলাে লাল হইয়া জ্বলিতেছে, তাহা আলাে নহে। অগ্নিদগ্ধ গ্রামের জ্বালার আলাে। অন্ধকারে সে উত্তরােল শব্দ ভাসিয়া আসিতেছে, তাহা ঝড়ের শব্দ নহে। পাকফৌজ দ্বারা আক্রান্ত গ্রামের করুণ আর্তনাদ। পিতামহের কবরে বাতি দিতে গিয়া বলিয়া আর ঘরে ফিরিতে পারিল না। প্রেতেরা তাহাকে অপহরণ করিয়াছে। প্রেতেরা পূর্ব বাংলার রাত্রির ঘুমের বুকেও ছুরি মারিয়া ঘুরিতেছে, প্রার্থনার ভাষা জোরে উচ্চারিত হয়না। স্বপ্নও বিড়বিড় করে না। প্রেতেরা চলিয়া যায়, রাত্রি শেষ মুহূর্ত ফুরাইয়া গিয়া ভাের হয়। কিন্তু জীবন্ত গ্রাম ততক্ষণে শবপুরী। হইয়া গিয়াছে। ইয়াহিয়ার আনন্দ তখন শকুনির উল্লাস হইয়া ও পাখা ঝাপটাইয়া মৃতদেহের মাংস খাইবার জন্য ব্যস্ত হয়। শকুনিরা ইয়াহিয়ার অন্তরাত্মারই দূত।
১৪ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা