শত্রু-মিত্র-বিচার
আগরতলা হইতে ছােট্ট একটি সংবাদ ভাসিয়া আসিয়াছে ! পাক বাহিনীর এগারােজন বালুচ সৈন্য বাংলদেশের মুক্তিফৌজে যােগ দিতে চান। প্রতিদিন শত শত তরুণ যে বাহিনীতে যােগ দিতেছেন সেখানে এগারােজন বালুচ খাতায় নাম লিখাইলেন কিনা, সামরিক দিক হইতে তাহা অবশ্যই তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু অন্য দিক হইতে এই ঘটনা নিশ্চয়ই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্য সংবাদটি যদি সত্য হয় তবেই । পরিবেশ এবং পরিস্থিতি আজ যে চেহারা লইয়াছে সেখানে এজাতীয় সংবাদ অনেকেই হয়তাে সহসা বিশ্বাস করিতে চাহিবেন না। কেননা, চিত্র আজ দুইটি মাত্র বর্ণ-পূর্ব আর পশ্চিম । দুই পাকিস্তানে সকলেই যেন ধরিয়া লইয়াছেন পূৰ-পূব, পশ্চিম-পশ্চিম এবং লড়াই এই দুই শত্রুর মধ্যেই। আমরা জানি পশ্চিমেও। শ্রেণীভেদ আছে, অনক্যৈর নানা উপকরণ সেখানেও ছড়ানাে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে যদি ‘মাই কানট্রি রাইট অর রং’-গােছের কোন উগ্রজাতীয়তাবােধ জাগিয়া থাকে তবে সেটা কোনও বিস্ময়কর ঘটনা নয়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা একটা বিশিষ্ট শ্রেণী হয়তাে কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নাই শাসক এবং শােষক কখনও কখনও ভিন্ন দুই জাতি হিসাবেই চিহ্নিত। আগেই বলা হইয়াছে এগারজন বালুচের এই সিদ্ধান্ত সামরিক দিক হইতে অবহেলাযোগ্য। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে বাংলাদেশের লড়াই মূলত রাজনৈতিক লড়াই; সশস্ত্র যুদ্ধ রাজনীতিরই সম্প্রসারণ মাত্র; পলিটিক্স বাই আদার মিন্স। এই লড়াইয়ের চুড়ান্ত ফলাফল শুধু রণক্ষেত্রে নির্ণীত হইবে না, বাংলাদেশের জনসাধারণের সংকল্পের মতােই, এ বিষয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানের মানুষের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অনেক। আখেরে এই যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায় প্রশ্ন তাহাদের পক্ষে এড়ানাে সম্ভব নয়। নৈতিকতা ছাড়াও আছে লাভলােকসানের প্রশ্ন।
ধনজনের বিনিময়ে কী তাহারা পাইল- সে কৈফিয়ৎও একদিন অবশ্যই তাহারা চাহিবে । এগারােজন বালুচের বিদ্রোহ বােধহয় তাহারই ইঙ্গিত। একালে সুশৃঙ্খল সৈন্যবাহিনীতে বিদ্রোহ দূরূহ হইলেও একেবারে অজ্ঞাত নহে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানবাহিনীকে দিয়া যদৃচ্ছ গণহত্যার কথা হিটলারও ভাবিতে পারেন নাই। নিরস্ত্র নিরপরাধ জনসাধারণকে এড়াইয়া চলাই ছিল সেনাপতিদের নির্দেশ। কেননা, নয়তাে বিদ্রোহের সম্ভাবনা। হিটলারের সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও জার্মান-সেনাপতি প্যারিস শহরকে ধ্বংস করিতে রাজী হন নাই- মহাযুদ্ধের ইতিহাসে এমন ঘটনাও আছে। লিডেল হার্ট লিখিয়াছেন- তাতার সেনাপতিরা হইলে কি করিতেন জানি না, কিন্তু জার্মান সেনাপতিদের দিয়া ইউরােপে গণহত্যা করানাে কট্টর নাৎসীদের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। শােনা যায়, পূর্ব জার্মানিতে এবং পরে হাঙ্গেরিতে বিদ্রোহ দমন করিতে গিয়া একই সমস্যায় পড়িয়াছিলেন রুশ সেনাপতিরা। কিছু রুশ সৈন্য নাকি নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালাইতে অস্বীকার করেন, কেউ কেউ যােগ দেন অন্যপক্ষে। ভিয়েৎনামেও নাকি এই নজির সৃষ্টি হইয়াছে, জন কয়েক মার্কিন তরুণ নাকি উত্তরের হইয়া লড়িতেছেন। কেবল ইয়াহিয়াই কি অন্য নজির সৃষ্টি করিবেন? সম্ভবত নয়। বালুচেরা জানাইল পশ্চিমে সকলেই ভুট্টো নহেন।
১৩ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা