সীমান্তের পরীক্ষা
ভারত সরকার প্রতিবাদ করিয়াছেন। প্রতিবাদের ভাষা নরম নহে, এবং বক্তব্যের মধ্যেও কোন অস্পষ্টতা। নাই। পাকিস্তানী ফেীজ যদি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী ভারতীয় অঞ্চলের উপর গুলি-গােলা চালাইবার হঠতাপূর্ণ অনাচার বন্ধ না করে, তবে তাহার পরিণাম ও প্রতিফলের ঘটনার জন্য পাকিস্তান সরকারই দায়ী হইবে। শুধু সীমান্তের ওদিকে থাকিয়া নহে, পাকিস্তানী ফৌজ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের ভিতরেও প্রবেশ করিয়া মানুষের প্রাণ সংহার করিয়াছে, ঘর পােড়াইয়াছে। তাহাদের হিংস্র বন্দুক ও বেয়নেটের আঘাতে গ্রামের মানুষ আহত হইয়াছে। ভারত সরকারের প্রতিবাদের কড়া নােট’ ঘটনার তালিকা এবং বিবরণ দিয়া সেই সঙ্গে ক্ষতিপূরণের দাবিও জানাইয়াছে। কিন্তু একাধিক প্রতিবাদের পরেও পাকিস্তানী ফৌজের সংযত হইবার কোন লক্ষণ দেখা যায় নাই। বরং বুঝিতে হইতেছে যে, সীমান্ত সম্পর্কে পাকিস্তানী ফৌজের ইচ্ছা ও অভিসন্ধি আরও স্পর্ধাশীল হইয়াছে। সীমান্তে তাহাদের গতিবিধি আরও প্রবল হইয়াছে। ভারতীয় সীমান্তের আরও নিকটবর্তী হইয়া তাহারা ঘাঁটি স্থাপন করিতে শুরু করিয়াছে। সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, তাহারা সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করিবার নূতন ব্যস্ততায় মাতিয়াছে। কিন্তু ইহাও আবার দেখা যাইতেছে যে, তাহারা সমগ্র সীমান্তে অবরােধ স্থাপন করিতেছে না। পূর্ব বাংলা হইতে অত্যাচারিত ও আতঙ্কিত অধিবাসী যাহাতে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও বিহারের অঞ্চলে চলিয়া যাইতে পারে, তাহার জন্যে সীমান্তের এখানে-ওখানে ইচ্ছাকৃত ফাক তাহারা রাখিয়াছে। পূর্ববঙ্গ হইতে বিপুল সংখ্যক অধিবাসীকে এবং হিন্দু অধিবাসীকে সমগ্রভাবে ভারতীয় আশ্রয়ের দিকে ঠেলিয়া দিবার একটি পাকা পরিকল্পনা পাকিস্তানের এই সামরিক তৎপরতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যে বেশ স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। কোন সন্দেহ নাই এক কোটি বা দেড়কোটি শরনার্থী পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করিয়া ভারতে চলিয়া আসিবার পরেই পাকিস্তানী সামরিক তৎপরতায় তৃতীয় পর্যায় শুরু হইবে। সীমান্তে তখন পূর্ণ অবরােধ স্থাপনা করিয়া পাকিস্তানী ফৌজ বর্তমানের শরণার্থী বহির্গমনের সব পথ বন্ধ করিয়া দিবে।
এক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য হইবে, যেন ভারতীয় অঞ্চলে আগত শরণার্থী জনতা পুনরায় পূর্ববঙ্গে ফিরিয়া যাইতে না পারে। ভারতীয় অঞ্চলের নানা স্থানে গুলি গােলা করিতেছে, তাহা সীমান্তকে আতঙ্কিত করিবার চেষ্টা। কিন্তু ভারতকে ঘায়েল করিবার জন্য এক বা দেড় কোটি অধিবাসী নিক্ষেপ করাই পাকিস্তানের গূঢ় ও প্রধান উদ্দেশ্য। ভারতের পক্ষে প্রসন্ন হইয়া থাকিবার কোন যুক্তিই নাই। পূর্ববঙ্গ হইতে বর্তমানে যে ত্রিশ লক্ষ অধিবাসী চলিয়া আসিয়াছে, তাহা ঘটনা হিসাবে ভারতীয় ভাগ্যের অতি দূরূহ একটি পরীক্ষা। এক কোটি বা দেড় কোটি অধিবাসী চলিয়া আসিলে সে পরীক্ষায় রূপ ও প্রকৃতি যে কত কঠোর হইবে, তাহা অনুমান করিতে পারা যায়। ভারতের অর্থনীতিক ও রাজনীতিক জীবনে নূতন সমস্যা ও উদ্বেগ অবশ্যই সঞ্চারিত হইবে। তাহা ছাড়া আইন-শৃঙ্খলার সমস্যাও আছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাহার একাধিক বিবৃতিতে সীমান্তে অস্ত্রশস্ত্রের অবাধ আনাগােনা সম্পর্কে সতর্ক হইবার প্রয়ােজনের কথা বলিয়াছেন। বিষয়টি কেন্দ্রেরও গােচরীভূত হইয়াছে। সম্প্রতি সংসদ সদস্য শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সী সীমান্ত অঞ্চল ঘুরিয়া এই সমস্যার প্রত্যক্ষ পরিচয় পাইয়াছেন। পূর্ববঙ্গ হইতে সীমান্ত পার হইয়া পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চলে আগত মুক্তিযােদ্ধা ও অন্যান্যেরা যে সকল অস্ত্রশস্ত্র আনিয়াছেন, রাইফেল, স্টেনগান, পিস্তল, ইত্যাদি, তাহা সংগ্রহ ও সংরক্ষিত করিবার উপযুক্ত সরকারী হেপাজত নাই। গােপন ক্রয়-বিক্রয়ের প্রকোপে পড়িয়া এইসব অস্ত্র ‘অবাঞ্ছিত’ লােকের হাতে চলিয়া যাইবার সুযােগ পাইতেছে। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, এই সুযােগ অব্যাহত থাকিলে শুধু সমাজবিরােধীরা নহে, হিংসাবাদী রাজনীতিক সশস্ত্র হইবার নূতন সুযােগ পাইবে। সমস্যাকে পরাভূত করিতে হইলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে এখন আরও বেশি করিয়া সীমান্ত সচেতন হইতে হইবে। শুধু সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং সাধারণ প্রশাসনের অভ্যন্ত রীতির তৎপরতার দ্বারা সঙ্কট প্রতিহত করা সম্ভব নহে।
১২ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা