You dont have javascript enabled! Please enable it!

এই দায় গােটা দুনিয়ার

১৯৪৭ হইতে ১৯৭০ তারপর এই ‘৭১। তেইশ-চব্বিশ বছর জুড়িয়া সীমান্তের ওপার হইতে এই বাংলায় যত শরণার্থী আশ্রয়ের জন্য আসিয়াছেন, এই চলতি ‘৭১-এর মাত্র মাস খানেকের মধ্যেই নতুন শরণাগতদের সংখ্যা তাহার এক পঞ্চমাংশ ছাপাইয়া গিয়াছে। এসবই অবশ্য সরকার খতিয়ান, আসল পরিসংখ্যান হয়তাে আরও অনেক বিরাট হইবে। দেশ-বিভাগের পর হইতেই যাহা ছিল ছােট বড় নানা স্রোতােধারা, তাহা অকস্মাৎ কুলপ্লাবীবন্যার রূপ লইয়া ভাঙিয়া পড়িয়াছে। নতুন আগন্তুকদের যে নামই দিইনা কেন- ইংরাজিতে রেফিউজি শব্দটি বাতিল করিয়া ইভাকুয়ি অথবা ফিউজিটিভ ইত্যাদি গালভরা নামে ডাকিলেও বিপন্ন মানুষকে সম্মান দেওয়া হয় না। যাঁহারা আগন্তুকদের আন্তর্জাতিক আইনগত স্টেটাস লইয়া অতিমাত্রায় ভাবিত, এটা সেই আমলাতন্ত্রের জন্যেই তােলা থাকুক।  বাস্তব কথা এই যে, উহারা আসিয়াছেন, আসিতেছেন। প্রধানত এই বাংলায়। সেইটাই স্বাভাবিক, বাংলাদেশের বাস্তুহারারা পশ্চিমবাংলায় না আসিয়া যাইবেন কোথায়, আমেরিকা, ব্রিটেন, জর্ডন কিংবা মরক্কোয় যাওয়া তাহাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই দেশ একে দুয়ার হইতে অদূরে, দ্বিতীয়ত সমভাষাভাষী। এখানে সমবেদনারও অভাব নাই।

পশ্চিম বাংলা সরকার বিভ্রান্ত হইয়া, শােনা যায়, কেবলই বলিতেছেন, এ দায় রাজ্যের নয়, জাতির দায়। কথাটা আংশিক সত্য মাত্র। জাতিয় কেন, ইহা প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক দায়। আবার ইহাও ঠিক দুনিয়ার একটি ভূভাগে হঠাৎ এতগুলাে মানুষ উনূল হইয়া গেল, অথচ দুনিয়ার বিবেকে তেমন কিছু সাড়া জাগিল না। আন্তর্জাতিক রেডক্রস গােড়ার দিকে “ফটক বন্ধ” এই হুকুম শােনামাত্র সরিয়া গিয়াছিলেন। সবে নাকি এতদিন পরে তাহাদের দুই প্রতিনিধি সমস্যাটাকে “সার্বিকভাবে যাচাই করার জন্য” জেনিভা হইতে কলিকাতা পর্যন্ত আসিয়া পৌছিতে পারিয়াছেন। নয়াদিল্লিতেও রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্তু বিশারদ কমিশনের তিন  সদস্য আসিয়া তত্ত্বতালাস শুরু করিয়াছেন। এই পরিস্থিতিতে আজ শনিবার চারজন আঞ্চলিক মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি যাত্রা । তাহারা প্রধানমন্ত্রীকে কতদূর বুঝাইয়া উঠিতে পারিবেন? নিছক “দেবে গৌরী সেন”- জাতীয় ভরসা লইয়া ফিরিয়া লইয়া আসা অনর্থক। সেটা হৃদশী বিচার। | প্রথমত, পূর্বেকার শরণাগতদের সঙ্গে এবারকার শরণাগতদের মূল একটি প্রভেদ- অনেকেই ফিরিয়া যাইতে চান। প্রায় সিকি শতক ধরিয়া যাহারা দেশের মাটি আঁকড়াইয়া পড়িয়া ছিলেন, তাহারা চিরনির্বাসিতের জীবন যাপনে কিছুতেই স্বীকৃত হইবেন না, কিন্তু ফিরিয়া যাওয়ার মতাে উপযুক্ত ক্ষেত্র এবং অনুকূল পরিবেশ চাই। প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, উদ্বাস্তুদের শুধু দেখাশােনা করিলেই হইবে না, তাহারা যাহাতে প্রত্যাবৃত হইতে পারেন তাহাও দেখিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী কথাটার তাৎপর্য কিংবা ব্যাখ্যা ব্যক্ত করেন নাই।। মুখ্যমন্ত্রীরা সেই ব্যাখ্যা আদায় করিয়া আনিতে পারিবেন কি? | প্রত্যাবর্তনের একমাত্র উপায় মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের জয়। সেটা দীর্ঘমেয়াদী বিচার এবং হিসাব। আপাতত প্রত্যাবর্তনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা পিণ্ডিশাহীর মতিগতি । লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে উৎচ্ছন্নে পাঠাইয়া হিটলার একটি বিশুদ্ধ আর্যরাষ্ট্র তৈয়ার করিতে চাহিয়াছিলেন।

পশ্চিম-পাকিস্তানের জঙ্গী জমানা কত বাঙালীর রক্তে সবুজ বাংলাদেশকে রাঙা করিয়া তবে অন্যায়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট একটি কৃত্রিম-রাষ্ট্রকে কায়েম করিতে চাহে? উত্তর দেবার দায় সমগ্র বিশ্বের । ভারতে আসিয়া ইহারা ঠাই লইয়াছেন বলিয়াই দায় একা ভারতের, একথা বলা যায় না। বিশ্ব রাজনৈতিক দায়িত্ব না হয় এড়াইয়া যাইতে চাহিতেছে, কিন্তু নৈতিক দায়িত্ব তাহাকে পালন করিতেই হইবে। অসহায় আগন্তুকদের আবার ঘাতকদের তােপের মুখে ঠেলিয়া দেওয়া যায় না। নবাগত শরণাগতদের মধ্যে বাস্তুহারা শুধু মুসলমান নহেন, হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই আছেন। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রগুলির দ্বিগুণ দায়িত্ব, সংখ্যাগুরুদের ক্ষেত্রেও কম নহে। কেননা স্বদেশ ও স্বাধিকার হইতে উভয়েই বঞ্চিত এবং বিতাড়িত। মানুষকে তাহার নিজভূমে নিধন করা যেমন মহাপাপ, তেমনই মহাপাপ আশ্রিত মানুষের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার- এই ঝড়ে জলে, জলাভূমিতে অনাদরে অবহেলায় তাহাদের ফেলিয়া রাখা। শুধু দিন যাপনের, শুধু প্রাণধারণের গ্লানি বড়ই ভয়ঙ্কর। | এতগুলি মানুষের ভাগ্য লইয়া এ এক যেমন মজার তেমনই নিষ্ঠুর খেলা চলিয়াছে। পাকিস্তান যদি তাহার অবাঞ্ছিত সন্তানদের ভার ভারতের হাতে তুলিয়া দিয়া দিব্যি নিশ্চিন্ত এবং অটুট থাকিয়া যায়, তবে তাহা হইবে আগামী ইতিহাসের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা। | সেই বিশ্বাসঘাতকতার দায় সমগ্র বিশ্বের । সমগ্র বিশ্বের, কিন্তু তাহার ফল ভােগ করিবে একা ভারত? প্যালেস্টাইনে উদ্বাস্তুরা, আলজেরিয়ার উদ্বাস্তুরা যে সমস্যা সৃষ্টি করিয়াছে, এখানেও তাহার পুনরাবৃত্তি ঘটিবে? ঘরে ফেরানাের সংকল্প উত্তম, কিন্তু সেজন্য বাস্তব প্রস্তুতি কোথায়? বাস্তববােধ বলিয়া দিতেছে যে, বাংলা দেশের সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হইবে। “জয় বাংলা” চট করিয়া জয়ী হইবে, এই অলীক ভরসায় শরণাগতদের না। ভােলানােই ভাল। তাহাদের জন্য সত্যকার কিছু করিতে পারি বা না পারি, বিতাড়িত মানবতাকে যেন প্রতারিত না করি।

স্বীকৃতিতে অস্বীকৃতি কেন?

সেই পুরাতন স্বীকৃতির প্রশ্নটা মাঝে মাঝে চকিতে আশার রেখা দেখাইয়া যেন মরীচিকার মতাে মিলাইয়া যাইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ প্রবল, প্রায় সমস্ত বিরােধী দল বারে বারে একবাক্যে বলিতেছেন, “বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিন।” এই দাবি নানা রাজনৈতিক দলের কণ্ঠে, এমনকী একাধিক রাজ্যের বিধানসভাতেও ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সর্বসম্মত প্রস্তাবটি নানাদিক হইতে ঐতিহাসিক । ইহার বয়ান বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি সৌভ্রাত্রের নিদর্শন তাে বটেই, সেই সঙ্গে বলিয়া দিয়াছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশের এই সংকটে তাহার কী প্রত্যাশা, এবং কী প্রয়ােজন। | দিল্লি তবুও মনে হয় এখনও মন স্থির করিয়া উঠিতে পারে নাই। কারণ ভয় নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই কথা ঘােষণা করিয়াছেন। ভয় যদি না হয়, দ্বিধার মূলে তবে কী? মুক্তি আন্দোলনের প্রতি এই দেশ পূর্ণ। 

সমর্থন জানাইবে, অথচ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে নয়-এই দুইটা মেলানাে একটু কঠিন। যেন দ্বিধার সঙ্গে কোথা দ্বন্দ্বও ঢুকিয়াছে। স্বীকৃতি আদৌ দেওয়া হইবে না; শ্রীমতী গান্ধী একথা অবশ্য বলেন নাই, শুধু অপেক্ষা করিতে বলিয়াছেন । অপেক্ষা, আর কতকাল অপেক্ষা? আরও কত নরবলির পরে? ভারতের দ্বিধার উৎস-সন্ধানে বাহির হইয়া প্রথমেই আমরা সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন তুলিয়া ধরিতে চাই। স্বীকৃতির শর্ত কী, কোন্ কোন্ উপাচার, উপাদান পূর্ণ হইলে একটি রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র বলে? রাষ্ট্র মানে কি শুধুই একটি ভৌগলিক সত্তা, আর জনতা? রাষ্ট্র তাহার চেয়েও কিছু বেশি সুসংগঠিত এবং আইনসঙ্গত একটা সরকারও চাই । তাজউদ্দিন সরকারকে ভারত এখনই মানিয়া লইতে পারিতেছে না-উত্তম। কেননা ভারতের মতে ওই সরকারের হাতে কোনও স্থিতিশীল ভৌগলিক ভূভাগ নাই। কিন্তু ইয়াহিয়া শাহীর হাতে আছে তাে? জঙ্গীবাহিনী গায়ের জোরে শহরের পর শহর দখলে রাখিয়াছে বা আনিয়াছে ইহা ঠিক। কিন্তু ইহাও একই রকম ঠিক যে, ওই মুলুকে অসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সরকারের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য যদি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়, তবে পূর্ববঙ্গে আজ পাকসরকারের কোনও প্রকার অস্তিত্ব নাই- দাপট আছে মাত্র। দাপটকেই কি দিল্লি অস্তিত্বের একমাত্র লক্ষণ বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে? সবার উপরে সত্য তবে বাহুল।

নহিলে আজ এই প্রশ্ন তােলা যাইত যে, ইয়াহিয়া সরকারকেই বা দিল্লি তথা সারাবিশ্ব স্বীকৃতি দিয়াছিল কবে? আয়ুবের বদলে ইয়াহিয়া ব্যাপারটা যদি নিছক সরকার বদলা হইত তবে নূতন করিয়া স্বীকৃতির কথা উঠিত না অবশ্য । কিন্তু ১৯৬৯ সনে ইয়াহিয়া যেভাবে ক্ষমতা গ্রাস করেন, ভূঙিয়া দেন বিধানসভা, বরখাস্ত করেন মন্ত্রীদের, বাতিল করেন সংবিধান- তাহাতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির মৌল চরিত্র একেবারে বদলাইয়া যায় । মিশরে নাগিব যখন এইভাবে গদি দখল করেন, হইয়া ওঠেন সর্বেসর্বা ডিক্টেটর, তখন কিন্তু ব্রিটেন তাহকে নূতন করিয়া স্বীকৃতি দিয়াছিল। সেই স্বীকৃতি ছিল “ডিফ্যাক্টো”। অর্থাৎ দেশের রাষ্ট্রের চরিত্র। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে আমূল বদলাইয়া গিয়াছিল বলিয়াই নূতন স্বীকৃতির প্রয়ােজন দেখা দিয়াছিল।

সেই দিক হইতে ইয়াহিয়া শাহী আজও অস্বীকৃতই রহিয়া গিয়াছে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র যেভাবে পয়দা হইয়াছিল, এ পাকিস্তান ঠিক সেই পাকিস্তান নহে। দুনিয়া চুপ করিয়া রহিয়াছে শুধু কি পেশীশক্তির প্রতি মবােধে? একটি অবৈধ সন্তান সকলের কাছে দিব্য জলচল হইয়া গেল, কিন্তু বৈধতার বিচার উঠিল সেই সরকার সম্পর্কে, বাংলাদেশ শাসন করায় যাহার গণতান্ত্রিক অধিকার। এই সরকারের পিছনে জনতা আছে, আছে বিপুল জনসমর্থন, শুধু ভৌগলিক ভাগ্যটা বিরূপ বলিয়াই সে অসিদ্ধ হইয়া যায়? এইভাবে বােধহয় স্বয়ং ঈশ্বরও অসিদ্ধ হইয়া যান প্রমাণ্যভাণ! ইহার পর কেহ যেন গণতন্ত্রের নামে কথায় কথায় শপথবাক্য উচ্চারণ না করেন। শক্তিই একমাত্র শর্ত গণতন্ত্রের এই তাে অর্থ দাড়াইতেছে? পিণ্ডিসরকারও যে পাকিস্তানকে আজ এক জাতি বলিয়া মনে করেন না, তাহার স্বীকৃতি পিণ্ডি ফৌজের আচরণেই আছে। বিশেষ করিয়া পশ্চিম-পাকিস্তানী সরকার বাঙালী জাতির নিধন-উৎসাদনে যখন মাতিয়াছে, তখন ধরিয়া লইতে হইবে ওই দেশে জাতি আসলে দুইটা।

দুইটি জাতিকে এক রাষ্ট্রের জোয়ালে বাধিয়া রাখিতে হইবে ইহা কোন্ দেশি জবরদস্তি? কুটনৈতিক বিধিবিধান ছাড়াও এই প্রসঙ্গে অন্তত ভারতের আরও কয়েকটা দিক ভাবিবার আছে। নানা রাজ্যে আর নানা দল সমস্বরে যে দাবি তুলিয়াছে, সে আহ্বান জানাইয়াছে তাহাকে উড়াইয়া দেওয়াও সরকারের পক্ষে প্রাত্তনজনােচিত হইবে না, ন্যায় সঙ্গতও না। কেননা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে গণতন্ত্র মানে সকল দল। ইহা ছাড়া আজ বাংলাদেশের বিপুল প্রত্যাশা ভারতের প্রতি যে শুভেচ্ছা জাগাইয়া তুলিয়াছে অতিমাত্রায় বিপ্লব ঘটিলে তাহা ধীরে ধীরে লয় পাওয়ারও বিলক্ষণ ভয়। সেই হতাশা আর তিক্ততার পটভূমিতে চীনের ছায়াটি দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইয়া যাইতে কতক্ষণ? আর আগানাে কঠিন, ভারত হয়তাে শুধু এইটুকুই তাকাইয়া দেখিয়াছে, কিন্তু এখনও খেয়াল করিতে পারে নাই যে, পিছানােও অসম্ভব। সময় আর স্রোত কাহার জন্য অপেক্ষা করে না, কথায় বলে । অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত বাংলাদেশের আক্রান্ত জনগণের আহত মুখােচ্ছবি হয়তাে একদিন নীরব তিরস্কারে ভারতকে বলিয়া দিবে- চিরতরে অপেক্ষা করিয়া রহে না প্রত্যাশী একটি জাতির ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা-ও।

১০ মে, ১০৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!