You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইহারা অধর্মে অন্ধ

ইহারা অর্থাৎ ইয়াহিয়ার অনুচর দস্যুরা, অর্থাৎ পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈনিকেরা পূর্ববাংলার জনজীবনের উপর। যথেচ্ছ অত্যাচার হত্যাকাণ্ড করিয়াও তৃপ্ত হয় নাই । লুণ্ঠন ও গৃহদাহ করিয়া কিছু তৃপ্তি বাড়াইয়াছেন। কিন্তু তাহাদের হিংস্র নিঃশ্বাস আরও তৃপ্তি খুঁজিয়াছে। এবং ঘটনার যে-সকল সংবাদ, সেই সঙ্গে ঘটনার কিছু চিত্র, যাহা ইতিমধ্যে অবরােধ অতিক্রম করিয়া প্রচারিত হইতে পারিয়াছে, তাহা হইতে ইহাই ধারণা করিতে হয়। যে, ধর্মস্থানের বিনাশ সাধন করিয়া তাহারা তাহাদের হিংস্রতার আরও একটি তৃপ্তি সম্ভব করিয়াছে। করিমগঞ্জের একটি সংবাদ প্রকাশ, শ্রীহট্টের যে-গ্রামটি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পিতৃভুমি, সেই গ্রামে শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃপুরুষের ভিটাবাড়ির উপর পাক-ফৌজের আক্রমণ ঘটিয়াছে। গৃহবাসীরা, যাঁহারা পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্রের বংশধর, তাহারা মন্দিরের বিগ্রহ লইয়া গ্রাম ছাড়িয়াছেন, এবং ভারতীয় জনপদ করিমগঞ্জে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। সংবাদপত্রের পাঠকরা ঢাকার রমনার কালিবাড়ির এবং ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ধ্বংসীভূত দশার ছবি দেখিয়াছেন। তাহাছাড়া, গােলার আঘাতে বিধ্বস্ত এবং অগ্নিদগ্ধ গির্জাবাড়ির ও মসজিদের ছবিও দেখিতে হইয়াছে। কিংবা শতাব্দীতে কোন রাষ্ট্রের জঙ্গী বা অজঙ্গী শাসকের পক্ষে ধর্মস্থানে এইরূপ যথেচ্ছ বিনাশ কখনও সম্ভব হইতে পারে বলিয়া কেহ কল্পনা করে নাই। কিন্তু পাকিস্তানের ইয়াহিয়া তা সম্ভব করিয়াছে। 

ধর্মান্ধের হিংস্র অপকীর্তির অনেক বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থে ছড়াইয়া রহিয়াছে। সেই অপকীর্তির বাস্তব। স্মৃতিচিহ্ন হইয়া অনেক প্রত্যক্ষ নিদর্শনও অনেক দেশের জনপদের এখানে ওখানে আজিও রহিয়াছে। মােগল ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতার ও ধর্মবিদ্বেষের ইতিবৃত্ত আজিও হারাইয়া যায় নাই। কিন্তু পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার ও তাহার সশস্ত্র অনুচরদিগের দ্বারা অনুষ্ঠিত এই উন্মত্ত ধর্মস্থান-বিনাশ হিংস্রতা হিসাবেও অভিনব। ইহা অধর্মান্ধতা। পাকিস্তানী বর্বরতার ইহা একটি বিশেষ পরিচয়। ইহুদীর সিনাগগ ভাঙিয়াছিল হিটলার; কিন্তু গির্জাকে ভাঙে নাই। মােগল ঔরঙ্গজেব হিন্দুর মন্দির ভাঙিয়াছিল কিন্তু কোন মসজিদকে ভাঙ্গে নাই । সুতরাং বলিতে হয় পাকিস্তানের ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানী মনােবৃত্তি বড়ই সমদর্শী। অর্থাৎ পূর্ব-বাংলার মন্দির মসজিদ ও গির্জা সবই তাহাদের কাছে না-পাক।  বাস্তব সত্য এই যে মনুষ্যত্বের বােধ ধারণা ও সংস্কারের শেষটুকুও বর্জন করিয়া পুরা বর্বর না হইয়া গেলে কাহারও পক্ষে ইয়াহিয়া হওয়া কিংবা ইয়াহিয়ার অনুচর হওয়া সম্ভব নহে। ইহারা পূর্ব-বাংলার জনজীবন ও ধর্মজীবনের রক্ত পান করিয়া এমনই এক নেশায় বিহ্বল হইয়াছে যে, পরিণাম কল্পনা করিবার মস্তিবুদ্ধিও তাহাদের আর নাই। থাকিবেই বা কেন? পৃথিবীর কোন দিক হইতে প্রতিবাদ ও পাল্টা আঘাতের সৎসাহস আজিও ইহাদের নেশা ছুটাইয়া দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ওঠে নাই। নেশা তাই আরও বাড়িতেছে।  ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ইউক্লিডের জ্যামিতিক সিদ্ধান্তের মতাে নিয়তি আপন নিয়মে এবং স্বতঃ আসিয়া অত্যাচারীর নিপাত সম্ভব করে না। | পাল্টা আঘাত কঠোরতম করিয়া অত্যাচারীর বিরুদ্ধে না হানিতে পারিলে অত্যাচারীর আপনি ক্লান্ত হইয়া ভালমানুষ হইয়া যাইবে না। ইতিহাসের অনেক ঘটনায় বরং ইহাই দেখা গিয়াছে রাজনীতিক বিচক্ষণতা শুধু ধৈর্য ধরিয়া এবং নিয়তি আপনি আসিবে বলিয়া স্বপ্ন দেখিয়া দেখিয়া অবশেষে নিজেই নির্জীব ও ক্লান্ত হইয়াছে এবং অত্যাচারী সেই দিকে তাকাইয়া চতুর হাসি হাসিয়াছে।

৮ এপ্রিল, ১৯৭১

 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!