অন্য পথ নাই
পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের সংগ্রামের একটি মাস অথবা তাহারও বেশি অতিক্রান্ত হইয়া গেল। অবিশ্বাস্য এক সংগ্রাম। পৃথিবীর ইতিহাসের কোনও পর্বে কোনও নিরস্ত্র প্রায় জাতি এমনভাবে হামলার মােকাবিলা করে নাই । ইহার পাশে ফরাসি, রুশ- সব বিপ্লবের লিখিত বৃত্তান্ত তুচ্ছ হইয়া যায়। ইহার পাশে হাঙ্গেরি অথবা চেকোশ্লোভাকিয়াকেও দাঁড় করানাে বৃথা। কেননা সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সত্যকার প্রতিরােধ ইহাদের কেহই দেয় নাই, দিতে পারিল না। ইহার পাশে দ্বিতীয় মহাসমরের ফ্রান্সের প্রতিরােধও তুচ্ছ, কেননা, তাহারা ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সম্মুখে সপ্তাহ পুরিতে না পুরিতে নতজানু হইয়া পড়িয়াছে। বাংলাদেশের প্রতিরােধ এক মাস ছাড়াইয়া দ্বিতীয় মাসে পড়িয়াছে। প্রকারে গেরিলা হউক বা না হউক- ইহার তুলনা নাই। এই যুদ্ধ ভারত চাক বা নাই চাক, সেও কোনও না কোনও প্রকারে অংশভাগী হইয়া পড়িয়াছে। প্রত্যক্ষ সমরে সে লিপ্ত হয় নাই সত্য, তাই বলিয়া ইসলামাবাদের নয়নে ভারতও কম দায়ভাগী নহে। পিণ্ডিচক্র নিরন্তর প্রচারে এই মিথ্যাটাই জাহির করিয়া চলিয়াছে। মিথ্যাটা সত্য একমাত্র একটি হিসাবে শরণাগতের তরঙ্গে। দশ লক্ষ? ওই পাটিগণিতটা ভুল। কতজন যে বাংলাদেশ হইতে চলিয়া আসিয়া স্বধর্মী এবং স্বজনের আশ্রয় লইয়াছেন, পরিসংখ্যানে তাহার কোন পরিচয় নাই। | এই শরণাগতদের কোন আখ্যায় চিহ্নিত করিব-রিফিউজি? সেটা অপমান । তাহাদের হয়তাে “ওয়ার। ইভাকুই” বলাই ঠিক হইবে। যেখানে একটি দেশ সামরিক সংগ্রামে লিপ্ত, সেখানে সম্প্রদায়ের প্রশ্ন ওঠে না, তবু ইহাও ঠিক যে নবাগতদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুরাই গরিষ্ট । ইয়াহিয়া চক্র এক উন্মত্ত নেশায় সকলের উৎসাদনে মাতিয়াছেন। কিন্তু বিশেষ করিয়া সে বাছিয়া লইয়াছে পূর্ব বাংলার হিন্দুদের । কেননা, মুসলিম তরুণ এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তদুপরি ওখানকার রাজনৈতিক মহল- চতুর পিণ্ডি জানে ইহার বাহিরে তাহার মৌল দুশমন মুসলিম সমাজে বেশী নাই। কিন্তু সংখ্যা লঘু, হিন্দুরা—যাহারা একবার কংগ্রেস আনুগত্যের মূল্য গণিয়া দিয়াছে তাহারা প্রত্যেকেই অধুনা আওয়ামী লীগের বশবর্তী । তাহাদের প্রায়শ্চিত্তের বুঝি আজও শেষ হইল না। সামরিক বা কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত কী কী করিতে পারে সে স্বতন্ত্র প্রশ্ন- সে বিতর্কিত প্রশ্ন। তাহা। লইয়া সাবধানী নানাপ্রকার হিসাব চলিতে পারে। কিন্তু এই যে নিপীড়িত মানবতার দায়ভার ইহা হইতে এ । দেশের কোনও প্রকারে রেহাই নাই । বর্তমান কোনও ভুলের না হউক, অতীত পাপের জের তাহার উপরই আসিয়া পড়িয়াছে।
উৎপীড়ক শাসকশক্তির হাতে পৃথিবীতে এই প্রথম বিপুল মানবতা গৃহছাড়া হইল না। নাৎসী আক্রমণের মুখে একদা এইভাবেই একদিন ইহুদীরাও উচ্ছন্নে গিয়াছে। কিন্তু সেদিন উৎপীড়িত, ঘরছাড়া ইহুদীরা ছড়াইয়া পড়িয়াছিল পৃথিবীর সর্বত্র। পাক-দুঃশাসকদের আঘাতে যাহারা বারবার হয়তাে এই শেষবার ঘরছাড়া হইয়াছে, তাহাদের পশ্চিম বাংলা ছাড়া দাঁড়াইবার আর কোন ঠেক নাই। তাহারা শুধু এই রাজ্যেই আসিয়া একটু নিরাপত্তা খোঁজে। সেইটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক যে তাহারা ত্রিপুরা, মেঘালয়, কিংবা আসামেও ততটা যায় না এমন কী। বর্মা মুলুকেও না। এই দিক হইতে তাহাদের শেষ ভরসা পশ্চিমবঙ্গ হয়তাে ভারতের এই অঙ্গরাজ্য বঙ্গভাষী বলিয়াই। এই স্পষ্ট সত্যটাকে কী ভারত, কী আন্তর্জাতিক মানবতা দরদী নানা সংস্থাকে অনুধাবন করিতেই হইবে। পুনর্বাসন নয়, ইহাদের প্রত্যেককে সসম্মানে সংস্থিত করার দায় সারা জগতের । ইহার মধ্যে হিন্দুমুসলিম সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের প্রয়ােজন নাই। তবু, ইহাও ঠিক যে বাংলাদেশের উৎখাত মুসলিম শ্রেণী যত শীঘ্র স্বদেশে এবং স্বভূমে প্রত্যাবৃত হইতে পারিবেন বিতাড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের তত শীঘ্র ফিরিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা কম। ইহা সাম্প্রদায়িক নহে। বাস্তব সত্য। আতঙ্কে, আঘাতে যাঁহাদের সিকি শতাব্দী কাটিয়াছে তাহাদের চট করিয়া সেই মৃত্যুপুরীতে ফেরত পাঠানাে হৃদয়হীনতার চরম- দিল্লিকে এই কথা বুঝিতে হইবে। পারে তাে সে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশকে সর্বোতভাবে প্রতিষ্ঠা দিক, জয়যুক্ত করুক নতুবা অন্তত প্রতিষ্ঠা দিক সংগ্রামে বিপন্ন মানবগােষ্ঠীকে । দয়া নয়, করুণা, ইহা ভারতের নৈতিক দায় । আইনগত হউক বা না হউক, মানবিক আহ্বানকে স্বীকৃতি দিতেই হইবে- নানাঃ পন্থা বিদ্যাতে অয় নাই, অন্য পথ নাই।
৪ মে ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা