You dont have javascript enabled! Please enable it! না -পুরুষ না-নারী - সংগ্রামের নোটবুক

না -পুরুষ, না-নারী

রাজস্থানের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কাছে এক প্যাকেট চুড়ি আসিয়া পৌছিয়াছে। পাঠাইয়াছেন এক মহিলা-সংস্থা। তাহাদের অনুরােধ, সহায়ক-সমিতি এই চুড়ির প্যাকেট যেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহামান্য সেক্রেটারি জেনারেল শ্রী উ থান্টের কাছে পাঠাইয়া দেন। ঘটনাটির তাৎপর্য বুঝিতে কাহারও কোনও অসুবিধা হইবার কথা নয়। বাংলাদেশের উপরে পাক ফৌজের যে দানবিক অত্যাচার চলিতেছে, তাহার বিরুদ্ধে উ থান্ট এখনও মুখ খােলেন নাই ইহা সেই নীরবতার প্রতিবাদ। উথান্টের জন্য যাহারা চুড়ি পাঠাইয়াছেন, বস্তুত তাঁহারা জানাইতে চান যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যিনি মুখ খােলেন নাই, তিনি পুরুষ বলিয়া আখ্যাত হইবার যােগ্য নহেন; নারীর ভূষণই তাহাকে মানাইবে ভাল। চুড়ি এ ক্ষেত্রে আর-কিছুই নয়, ধিক্কারের প্রতীক। সেই । প্রতীকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি-জেনারেলের নীরব নিষ্ক্রিয়তাকে ধিক্কার দেওয়া হইয়াছে। | বলা বাহুল্য, ধিক্কার দিবার এই পদ্ধতিটা কিছু নূতন নয়। অন্তত এ দেশে অনেক কাল ধরিয়াই এইভাবে প্রতীকের মাধ্যমে ধিক্কার দিবার প্রথা প্রচলিত রহিয়াছে। সেকালে দুর্বলচিত্ত রাজা-বাদশাদের অনেক ক্ষেত্রে কর্তব্যে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য অনুরূপ প্রতীকী পদ্ধতিতে ধিক্কার দেওয়া হইত। অন্যায়ের কাছে যিনি নতিস্বীকার করিতে চলিয়াছেন, নারীর বসন কিংবা ভূষণ পাঠাইয়া প্রকারান্তরে তাঁহাকে জানাইয়া দেওয়া হইত যে, তাহার আচরণ নিতান্তই নারীসুলভ; যে ভীরুতার পরিচয় তিনি দিতেছেন, তাহা পুরুষের সাজে  প্রথা ছিল এই সঙ্গে তলােয়ার ও শিকল পাঠাইবারও। অনাের রাজ্য আক্রমণের প্রাক্কালে আক্রমণকারী রাজারা তাহাকে দূতের মারফতে এই বস্তু দুইটি পাঠাইয়া দিতেন। তলােয়ার গ্রহণের অর্থ যুদ্ধ; আর শিকল গ্রহণের অর্থ বিনাযুদ্ধে বশ্যতাস্বীকার ।

বলা বাহুল্য, এক দিকে অনেকে যেমন শিকলের অপমান মানিয়া লইয়া প্রাণ বাঁচাইতেন, অন্য দিকে তেমনি আবার তলােয়ার গ্রহণ করিয়া শিকল ফেরত পাঠাইবার মতাে মানুষেরও অভাব ছিল না। সেও প্রতীকী ব্যাপার। আবার, আগেই বলিয়াছি উথান্টকে চুড়ি পাঠানােও একটা প্রতীকী ঘটনা। কিন্তু উথান্ট মানুষটি আসলে কে? রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি-জেনারেল পদটা খুবই জমকালাে তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু বস্তুত তিনি ওই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের একজন মােটা-মাহিনার চাকুরিয়া ভিন্ন আর-কিছুই নন। যাহারা ওই চাকুরি তাঁহাকে দিয়াছেন তাহার ক্রিয়াকলাপও যে তাঁহারাই নিয়ন্ত্রণ করিবেন, ইহাতে আর বিস্ময় কী? নীরবতার। দোষ আসলে তাহার নয়, এবং নিষ্ক্রিয়তার পাপ আসলে সেই শক্তিমান রাষ্ট্রনায়কদের, অন্যায়ের সঙ্গে আপােস করিতে যাহাদের বিবেকে বাধে না। একই সঙ্গে স্বীকার্য, তাহাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে ‘মেয়েলী ব্যাপার বলিলে নারীত্বকে অকারণে অপমান করা হয়। যে হাত চুড়ি পরে, সেই হাত যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তলােয়ার ধরিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয় না, সর্বযুগেই তাহার প্রচুর দৃষ্টান্ত। এই সেদিনই যে-রােশেনারা নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়া শত্রুসেনার ট্যাঙ্ক ধ্বংস করিয়াছেন, তিনিও তাে নারীই। না, রাষ্ট্রপুঞ্জের নীরবতার মধ্যে যেমন পৌরুষ নাই, তেমনি নারীত্ব নাই। এই নীরবতা আসলে নপুংসকতার পরিচয়কেই পরিস্ফুট করিয়াছে।

২ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা