এখনও আইনের কচকচি
নীতিশাস্ত্রের সেই ভুতটা নয় দিল্লির প্রশাসনিক দপ্তরের সাউথ ব্লকে বাসা বাঁধিয়াছে সেখান হইতে সেটি নড়িবার নাম পর্যন্ত করিতেছে না। কাশ্মীর-সমস্যার সমাধান যে হয় নাই সেটা মূলত ওই ভুতের কীর্তি। পাকিস্তানের নিকট হইতে আমাদের পাওনা গণ্ডা যে আমরা আদায় করিতে পারি নাই সেও ওই ভুতের দৌরাত্ম্যে। আজ আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘন করিয়া পাকিস্তানী সেনারা যে বারবার হানা দিতে সাহস পাইতেছে তাহাদের ভরসাও ওই ভুত । তাহারা বিলক্ষণ জানে, নীতিশাস্ত্রের বিধান ছাড়া ভারতবর্ষ এক পা চলিবে না, আর সে বিধান যে কী ভারতবর্ষ সেটা বুঝিতে এবং বুঝিয়াও সে অনুসারে কাজ করিতে করিতে তাহারা নিজেদের কাজ গুছাইয়া লইবে। দিনের পর দিন পাকিস্তানী হানাদারেরা এপারে আসিয়া অত্যাচার করিতেছে নরহত্যা করিতেও দ্বিধা করিতেছে না। আর আমরা কেতাব খুলিয়া খুঁজিতেছি নীতিশাস্ত্রের কোন্ কোন্ বিধি। ইসলামাবাদ লঘন করিল। যে কান্ড উচ্ছল পাকিস্তানী ফেীজ সীমান্তের এপারে করিতেছে তাহাতে পাথরের মূর্তিও ক্ষেপিয়া যায়, রক্তমাংসের মানুষ তাে কোন্ ছার। কিন্তু নয়াদিল্লির এমনই অসাধারণ আত্মসংযম যে এততেও সেখানে। উত্তেজনা জাগে নাই । পাকিস্তান কী কী চুক্তি ভঙ্গ করিয়াছে তাহার ফিরিস্তি তৈয়ারি করিতেই ভারত সরকার ব্যস্ত। তাহার ঔদ্ধত্যের মুখের মতাে জবাব না দিয়া তাঁহারা তাহার কাছে নীতিশাস্ত্রের দোহাই পাড়িতেছেন। যাহারা গির্জা মন্দির তাে বটেই, মসজিদ ভাঙিয়া চুরমার করিতেছে, বিধর্মী তাে বটেই স্বধর্মীদেরও রেহাই দিতেছে না। তাহাদের কাছে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নীতিশাস্ত্রের অনুশাসন, চুক্তির ধারা সবই তাে তামাসার বস্তু। সে সব যদি তাহারা মানিত তাহা হইলে বাংলাদেশে রক্তবন্যা বহিয়া যাইত না, ভারতীয় কূটনীতিকদের ঢাকায় অন্তরীণ করিয়া রাখা হইত না। সীমান্তের এপারে আসিয়া যখন তখন পাক সেনারা নিরীহ লােকেদের উপর জুলুম করিত না, ভারতের বুকের উপর নৃশংস হত্যালীলা চালাইতনা। | চিঠি-চাপাটির দিন অনেক আগেই চলিয়া গিয়াছে, আইনের কচকচিরও। আগুন এখন আর আমাদের দরজায় নাই, আমাদের ঘরেও ঢুকিয়াছে । কাজটা অন্যায় হইতেছে বলিয়া তারস্বরে চেঁচাইলে কোনও ফল আর হইবে না।
এখন এ সঙ্কটের মােকাবিলা আমাদের নিজেদেরই করিতে হইবে, শুধু আগুন নিভাইয়া নয়, আগুন যাহাতে আর না জ্বলে তাহার ব্যবস্থা করিয়া। আঁড় ক্ষেপিলে মন্ত্রপাঠ করিয়া তাহাকে শান্ত করা যায় তাহার উপায় ভিন্ন। পাকিস্তানও সেই ক্ষেপা ষাঁড়ের মতােই ব্যবহার করিতেছে। অতএব তাহাকে শায়েস্তা করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করিতে হইবে। সে ব্যবস্থা নােট পাঠানাে নয়, চুক্তিভঙ্গের কথা তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া নয়। পাকিস্তানের চুক্তিভঙ্গ তাে দৈবাৎ হইয়া যায় নাই। কাজটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। কাজেই চুক্তিভঙ্গের অভিযােগ ভুলিয়া তাহাকে তাে আর নিবৃত্ত করা যাইবে না। | এখন মামুলী নােট পাঠানাে এবং প্রতিবাদ জানানাে নিস্ফল তাে বটেই, অসমীচীনও। যত চিঠি চাপাটি। পাঠাইয়া আমরা সময় নষ্ট করিব পাকিস্তান ততই পাইয়া বসিবে। ইয়াহিয়া খাঁ তাহার অনুগতেরা সে সব। নােট বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলিবে, বিদ্রুপের হাসি হাসিবে। আর বাংলাদেশে যাহারা লড়াই চালাইতেছে। সেই পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢালাও হুকুম দিবে সীমান্তের দুই পারে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করিতে। চল্লিশজন ভারতীয় নাগরিককে পাকিস্তানী সেনারা বধ করিয়াছে শুনিয়া ইসলামাবাদে জঙ্গীশাহী দুঃখিত হয়তাে হইবে, চল্লিশজন নিরীহ ব্যক্তি মারা গিয়াছে বলিয়া নয়- চারশাে জন কেন মরিল না এই ভাবিয়া বর্বরদের উপদেশ দিয়া তাহাদের উপদ্রব বন্ধ করা যায় না। হাতে নাতে তাহাদের বুঝাইয়া দিতে হয় তাহার প্রতিফল কী। যে। পূজার যে মন্ত্র- এই সােজা কথাটা যদি নয়াদিল্লির দিকপালদের মনে না পড়ে তাহা হইলে পাকিস্তান সীমান্তে শান্তি ফিরিয়া আসিবে না- অত্যাচারের মাত্রা সেখানে আরও বাড়িয়া যাইবে।
৩০ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা