You dont have javascript enabled! Please enable it! তােমার পতাকা যারে দাও - সংগ্রামের নোটবুক

তােমার পতাকা যারে দাও

“তােমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’- কবির উক্তিতে যে-তত্ত্ব অভিব্যক্ত হইয়াছে তাহা। মানবীয় জীবনের সাধারণ সত্য এবং ইতিহাসের বিশেষ সত্য। শুভ অভীষ্টের লক্ষ্যে যাহারা অগ্রসর হইতে চাহে, তাহাদের পতাকা হইল তাহাদের সংকল্পেরই প্রতীক। এই পতাকা পথ যাত্রিকের জীবনের ভার নহে, জীবনের প্রেরণা। এই পতাকা ধারণ ও বহন করিয়া কেহ ক্লান্ত হয় না। ইতিহাসের হাজার ঘটনায় বরং ইহাই দেখা গিয়াছে যে, শুভ অভীস্টের ও দেশপ্রেমের এবং স্বাধীনতার পতাকা বহন করিলে বহন করিবার শক্তি আপনি আসিয়া পড়ে। ইতিহাসের পৃষ্ঠা অজস্র ঘটনার তথ্য বহন করিতেছে; যাহাতে দেখা যায় যে, দেশপ্রেমিকের স্বাধীনতার যে সংগ্রাম সামান্যভাবে সূচিত হইয়াছিল, পরিণামে একদিন তাহা প্রবল ও বিশালরূপ গ্রহণ করিয়াছে। শিবাজী যেদিন প্রথম একটি অতি-সাধারণ মােগল-দূর্গ অধিকার করিয়াছিলেন, সেদিন মহারাষ্ট্রের অন্যান্য বিচক্ষণ সামন্তদিগের কেহ কল্পনা করিতে পারেন নাই যে, যে-শক্তি একদিন মােগল শক্তিকে বিচলিত ও ছিন্নভিন্ন করিবে, যাহা একদিন শক্তির মহীরূহ হইয়া উঠিবে, তাহার প্রথম পরিচয় শিবাজীর ওই কৃতিত্বের মধ্যে অঙ্কুরিত হইয়াছে। প্রাথমিক ফলাফল ওজন করিয়া ও হিসাব করিয়া সংগ্রামের কৃতিত্বকে সামান্য বলিয়া মনে হইতে পারে; কারণ সংকল্পের নিষ্ঠা ও বিপুলতার হিসাব অনেক সমালােচকই করিতে পারেন না, করিতে জানেনও না। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধার কৃতিত্ব ও সফলতার বিচার করিতে কাহারও কাহারও কিংবা অনেকেরই ভুল হইতে পারে। প্রাথমিক সফলতাকে ছােট করিয়া দেখিবার এবং বিফলতাকে বড় করিয়া দেখিবার ভুল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মাস মুক্তিযােদ্ধার পক্ষে অত্যন্ত কঠোর এক পরীক্ষার অধ্যায়। সে পরীক্ষার কঠোরতা এখনও মৃদু হয় নাই। কিন্তু এই পরীক্ষায় মুক্তিফৌজ অন্তত এইটুকু সত্য নিসংশয়ে প্রমাণিত করিয়াছে যে, পতাকা বহন করিতে তাহার বাহু কোন ক্লান্তি অনুভব করে নাই। পাকিস্তানের চারি ডিভিসন সশস্ত্র জল্লাদ এবং ট্যাঙ্ক মেশিন-গান ও জঙ্গী বিমানের অগ্নিময় যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সামান্য রকমের ও সামান্যতম অস্ত্র লইয়া মুক্তিযােদ্ধার দল যে-ভাবে যেখানে যতটুকু প্রতিরােধ হানিতে সক্ষম হইয়াছে, তাহা সামরিক বিশেষজ্ঞদের পক্ষে বিস্ময়ের ঘটনা বলিয়া বিবেচিত হইবে। পাকিস্তানী ফৌজের কৃতিত্ব বলিতে শুধু ইহাই বুঝায় যে হাজার হাজার (হয়তাে কয়েক লক্ষ) নিরস্ত্র মানুষকে স্বচ্ছন্দে হত্যা করিয়াছে। ইহা সামরিক কৃতিত্ব নহে। ইহার মধ্যে সামরিক দক্ষতার কোন প্রমাণ নাই। ইহা চারি ডিভিসন সশস্ত্র কাপুরুষের দ্বারা অনুষ্ঠিত নরশােণিত পানের উন্মত্ত উৎসব। কোনও সন্দেহ নাই, মুক্তিযােদ্ধারা যদি তাহাদের বর্তমান সংগঠনের মধ্যে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতার মধ্যেই উন্নত প্রকারের অস্ত্রশস্ত্রের অজস্র সরবরাহ পাইবার সুযােগ লাভ করেন, এবং অন্তত একটি সশস্ত্র আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসৈন্য ব্রিগেডের সহযােগিতা পাইতে পারেন, তবে রণাঙ্গনের ছবি কয়েকঘণ্টার মধ্যে বদলাইয়া যাইবে। জল্লাদ-কর্মে অভ্যস্ত পাক-বাহিনীর হৃৎপিণ্ড বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরােধের আঘাত সামলাইতে পারিবে না। শুভ অভীষ্টের পতাকা যাহাদের হাতে আছে, তাহারাই জয়ী হইবে।

২৯ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা