You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.28 | আগুন লইয়া খেলা - সংগ্রামের নোটবুক

আগুন লইয়া খেলা

পাকিস্তান দেখিতেছি আগুন লইয়া খেলিতেছে। যে আগুন সে আজ নিজের ঘরে জ্বালাইয়াছে তাহাতে তাহার সর্ব পুড়িয়া যাইবার জো হইয়াছে। তাই দিশাহারা হইয়া সে চেষ্টা করিতেছে ওই সর্বনাশা আগুন এই উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়াইয়া দিতে অন্তত দুই বঙ্গ জ্বলিয়া পুড়িয়া খা হইয়া যাক, ইহাই তাহার বাসনা। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে ইদানীং যে সমস্ত কাণ্ডকারখানা পাকিস্তানী সেনারা করিতেছে সেগুলি মােটেই আকস্মিক নয়, ভুলের ফসলও সে সব নয়। ইচ্ছা করিয়াই তাহারা সীমান্ত লঙ্ঘন করিয়া এপারে আসিয়া গুলি ছুঁড়িতেছে। সে গুলিবর্ষণ লােক-দেখানাে ব্যাপার নয়। প্রাণহরণই তাহার লক্ষ্য এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট পাকিস্তানী সেনারা কদাচিৎ হইতেছে। সীমান্তের ওপারে যেমন নিরস্ত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করিয়া তাহারা বীরত্ব দেখাইতেছে, এপারেও তাহাই তাহারা করিতেছে। | ব্যাপক গণহত্যার অবকাশ এপারে অবশ্য নাই। কিন্তু যে-ভাবে তাহারা নিরীহ ভারতীয় নাগরিকদের বধ করিতেছে গণহত্যা অপেক্ষা তাহা কম নিন্দনীয় নয়। শান্তির সময় বিদেশে পাড়ি দিয়া সেখানকার অস্ত্রহীন নরনারীকে মারিয়া ফেলার মতাে জঘন্য অপরাধ আর কী আছে? আর দিনের পর দিন সেই অপরাধই তাহারা নির্বিচারে করিয়া যাইতেছে যেন আন্তর্জাতিক আইন বলিয়া কিছু নাই, যে এ উপমহাদেশে জঙ্গলের শাসন চলিতেছে । যত দিন যাইতেছে তত পাকিস্তানের স্পর্ধা আরও বাড়িয়া যাইতেছে তাহার আক্রমণের পরিধিও বাড়িতেছে, আক্রান্তের সংখ্যাও। মঙ্গলবার তাহারা অন্তত পাঁচটি এলাকায় সীমান্ত লঙ্ঘন করিয়া ভারতীয় অঞ্চলে আসিয়া নরহত্যা করিয়াছে। অন্তত তেত্রিশজন ভারতীয় নাগরিক ওইদিন পাকিস্তানী নিষ্ঠুরতার শিকার হইয়াছেন।

দিনের পর দিন ওই অত্যাচার চলিবে, আর আমরা চুপ করিয়া বসিয়া থাকিব-এ কেমনতর কথা? পাকিস্তানী সেনাকে পাল্টা আক্রমণ না হয় আমরা নাই করিলাম, কিন্তু তাহাদের সীমান্ত লঙ্ঘন কি আমরা বন্ধ করিতে পারিব না? ওপারে গিয়া তাহাদের শিক্ষা দিয়া না হয় নাই আসিলাম, কিন্তু এপারে তাহারা হাঙ্গামা বাধাইলেও তাহাদের উচিত শিক্ষা দিব না, এ কোন্ নীতি শাস্ত্রের বিধান? ব্যাধিটা বােধহয় আমাদের সেই পুরাতন, পাছে লােকে কিছু বলে সেই ভয়েই আমরা সীমান্ত সুরক্ষিত করিবার ব্যবস্থা করিতেও দ্বিধা বােধ করিতেছি। কিন্তু যেখানে হানাদারের হাতে আমাদের শান্তিপ্রিয় নাগরিকেরা প্রাণ হারাইতেছে সেখানে আবার এ চক্ষুলজ্জা কেন? আর কাহার জন্যই বা সে চক্ষুলজ্জা? অপরের মুখ চাহিয়া পাকিস্তান তাে কই বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করে নাই, ভারতীয় এলাকায় হানা দিতেও তাহার তাে কই বাধিতেছে না। যত হাঁচি টিকটিকি আঁস্ত্যকুড় আর ভাদ্ৰবউ কি আমাদেরই মানিয়া চলিতে হইবে? কথাটা আন্তর্জাতিক আইন কিংবা কূটনৈতিক রীতিনীতি মানা না মানা লইয়া নয়, কথাটা আমাদের আত্মরক্ষার দায়িত্ব সম্পর্কিত, আমাদের জাতীয় মর্যাদা বজায় রাখার প্রশ্ন। যে সরকার নিজের প্রজাদের রক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারে না, তাহার মুখে আন্তর্জাতিক বুলি সাজে না। পাকিস্তান তাহার রেডিও মারফত যে বিদ্বেষ বিষ ছড়াইতেছে তাহার জবাবে খিস্তি খেউড় শুরু না করা অসমীচীন নয়। কিন্তু তাহারা যখন আমাদের সার্বভৌম অধিকার ক্ষুন্ন করিয়া সীমান্তের এপারে আসিয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালাইতেছে তখনও আমরা শান্তিজপ করিয়া চলিব, এ কোন্ দেশি কথা? আর কিছু না হউক সীমান্তে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করিয়া তুলিতে হইবে যাহাতে পাকিস্তানী বীরপুঙ্গরা আমাদের প্রহরীদের ঘাটাইতে ভয় পায়। তবুও যদি এপারে আসার স্পর্ধা তাহাদের হয় তাহা হইলে তাহাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার, যাহাতে ভারতবর্ষে। হানা দেওয়ার সাধ তাহাদের চিরতরে ঘুচিয়া যায় । তেমন করিলে যুদ্ধের জালে পাকিস্তান আমাদের হয়তাে জড়াইয়া ফেলিবে, এ আশঙ্কা অমূলক না হইতে পারে। তাই বলিয়া পড়িয়া মার খাওয়ার তাে কোনও অর্থ হয়না। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানীদের বুকের পাটা আরও বাড়িয়া যাইবে। পাকিস্তান চিরদিনই শক্তের ভক্ত, নরমের যম, আমরা শক্ত না হইলে সে নরম হইবে না। আগুন লইয়া খেলিতে হাত শুধু নয়, মুখও যে পোড়ে, সে শিক্ষা তাহাকে দেওয়া দরকার।

২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা