অরণ্যে রােদনই সার
দুই দেশের দুই সংসদ সদস্য বাংলাদেশে পাকিস্তানী উন্মত্ত তাণ্ডব দেখিয়া বিচলিত হইয়াছেন। শ্রী বি ডগলাস ম্যান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য; শ্রী ট্রেভর জে ইয়ং নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্টের। দুইজনের বক্তব্যের মূল কথা। একই- নির্বিচারে বাংলাদেশের নিরস্ত্র অধিবাসীদের নৃশংসভাবে হত্যা করিয়া পাকিস্তান যে জঘন্য অপরাধ করিয়াছে তাহার ক্ষমা নাই, সে নরমেধ যত শীঘ্র সম্ভব বন্ধ করার জন্য সারা বিশ্বের তৎপর হওয়া উচিত। শ্রীম্যানের মতে নিরপরাধের রক্তপাতের অবসান ঘটাইবার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উচিত সেখানে অবিলম্বে সৈন্য পাঠানাে । শ্রী-ইয়ংয়ের দাবি পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানাে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রেই বন্ধ করিয়া দিক, যাহাতে বাংলাদেশের মারণযজ্ঞের ইন্ধন তাহার না জোটে। তাছাড়া, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক অবরােধ এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কথাও তাহারা তুলিয়াছেন। কিন্তু শ্রী ম্যানতাে আর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নন যে, ব্রিটিশ সরকার তাহার পরামর্শ মানিয়া লইবেন। শ্রী ইয়ংও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসিয়া নাই যে, সরকারী নীতি তিনি বিধৃত করিবেন। এমন কী। তাহাদের দুজনের কেহই মন্ত্রীসভা কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্য নন যে সরকারের নীতির উপর তাহারা। প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবেন। দুজনেই বিরােধী শ্রমিক দলের সদস্য, কাজেই প্রত্যক্ষভাবে সরকারি নীতির কোনও রদবদল ঘটানাে তাহাদের সাধ্যাতীত। চেষ্টা তাহারা স্বদেশে ফিরিয়া গিয়া নিশ্চয়ই করিবেন, কিন্তু তাহাতে কোনও ফল হইবে কী? যদি সরকারের টনক না নড়ে তাহা হইলে তাহাদের অরণ্যে রােদনই সার হইবে, ওদিকে স্বাধীনতার পূজারী বাংলাদেশের নাগরিকদের যন্ত্রণ বাড়িয়াই চলিবে। বিরােধীর আসন হইতে যে স্বচ্ছ দৃষ্টি লইয়া শ্ৰীম্যান এবং শ্রী ইয়ং বাংলাদেশের ঘটনাবলি পর্যালােচনা করিয়াছেন, ক্ষমতার পরকলা চোখে আঁটিয়া বসিলে সেটা কী সম্ভব?
তাহারা দুইজন যে সব মন্তব্য করিয়াছেন তাহাতে আদৌ অতিরঞ্জনের স্পর্শ নাই। বরঞ্চ অব্যাপারে ব্যাপার করিবার বাসনা তাঁহারা স্পষ্টত দমন করিয়াছেন। তাঁহারা যদি বুঝিতেন বাংলাদেশে যাহা ঘটিতেছে । সে সবই পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার, তাহা হইলে তাহারা নাক গলাইতে যাইতেন না। কিন্তু একটা দেশে। সংখ্যালঘিষ্ঠের দল প্রশাসনযন্ত্রকে ছলে বলে কৌশলে করায়ত্ত করিয়া যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের অস্তিত্ব পর্যন্ত। নির্মমভাবে মুছিয়া ফেলিতে চায় তাহা হইলে তাহাকে ঘরােয়া ব্যাপার বলিয়া বিশ্বযুদ্ধ লােক চুপ করিয়া । থাকিবে? কথাটি পর্যন্ত কহিবে না? তা যদি হয় তবে আর মানবিক অধিকারের এ ভণ্ডামি কেন? কেন হাঙ্গারি, চেকোস্লোভাকিয়া, ভিয়েতনাম আর তিব্বত এ কান্নাকাটি, এত হা-হুতাশ? বাংলাদেশে যাহা ঘটিতেছে তাহাতে পাকিস্তানের মুখ তাে পুড়িয়াছেই, কিন্তু দুনিয়ার স্বাধীন প্রগতিশীল রাষ্ট্রগুলির মুখ কি উজ্জ্বল হইয়াছে? ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, পাকিস্তানের পাপ কাহাকে না স্পর্শ করিতেছে, ভারতবর্যের কথা না হয় নাই তুলিলাম? বাংলাদেশের ঘটনা যে বিশ্ববিবেকের উপর বিন্দুমাত্র ছায়াপাত করে নাই সেটা সমগ্র মানবজাতির গভীর। লজ্জা, নিদারুণ কলঙ্ক। ব্যাপক গণহত্যার কোনও প্রতিবিধান যদি সভ্য জগৎ করিতে না পারে, তবে অসভ্য। সমাজের সঙ্গে তাহার পার্থক্য কোথায়? নিউইয়র্কে ইউনাইটেড নেশনস্ বলিয়া একটা বিরাট প্রতিষ্ঠান যে আছে তাহার কাজ তাহা হইলে কী? ঘটা করিয়া এক নিরাপত্তা পরিষদ যে গড়িয়া তােলা হইয়াছে সে কি শুধু বৃহৎ শক্তিদের স্বার্থ রক্ষা করিবার জন্য কিংবা তাহাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মীমাংসার নিমিত্ত? ইউনাইটেড নেশন্সের সেক্রেটারি জেনারেল তাে কথায় কথায় ভিয়েতনাম-লাওস-কম্বােডিয়ার দুঃখে কাদিয়া ভাসাইয়া দেন, তঁাহার দৃষ্টি দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের উপর ভুলিয়াও পড়িতেছে না কেন? তবে কী বুঝিতে | হইবে- নীতির কোনও বালাই ইউনাইটেড নেশন্স্ কিংবা তাহার সেক্রেটারি-জেনারেলের নাই? বাহবা কুড়ানােই বুঝি জাতিপুঞ্জের কর্ণধারদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের আনুকূল্য করিলে কে আর হাততালি দিবে? বিশ্ববিবেকও তাই বুঝি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। বাঙালীর করুণ আর্তনাদে সে কপট দ্রিা ভাঙিবে না ।
২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা