You dont have javascript enabled! Please enable it!

এ দায়িত্ব সবারই

পশ্চিম-পাকিস্তানী দানবের দল এতকাল বাংলাদেশের রক্ত শুষিয়া খাইয়াও তৃপ্ত হয় নাই, সে দেশে এখন রক্তগঙ্গা বহাইয়া তাহারই স্রোতে স্নান করিতেছে। শৌর্যবীর্যের কোনও সম্পর্ক ওই রক্তপাতের সঙ্গে নাইনিরস্ত্র জনতাকে হত্যা জল্লাদের কাজ, বীরের নয়। প্রায় এক মাস ধরিয়া দিনের পর দিন সেই বীভৎস কান্ডই করিয়া চলিয়াছে ইয়াহিয়া খার দুর্ধর্ষ সেনা। শহরের পর শহর তাহারা আকাশ হইতে বােমা ফেলিয়া ধ্বংস করিতেছে, অস্ত্রহীন নরনারীকে নিষ্ঠুরভাবে বধ করিয়া পৈশাচিক আনন্দে মাতিয়া উঠিতেছে। তাহাদের নির্মম অত্যাচারে বাংলাদেশের আর্থিক জীবন আজ বিপর্যস্ত। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ, কলকারখানার চাকা অচল, মাঠে মাঠে যেটুকু চাষ হইতেছে সেও প্রায় না হওয়ার শামিল। এই ভয়াবহ পরিবেশে সাধারণ গৃহস্থের বাঁচিয়া থাকা একটা কঠিন সমস্যা। ইয়াহিয়া খাঁর যমদূতেরা কখন আসিয়া কাহাকে জীবন্ত গাের দিবে, সে কথা কেহই জানে না। কাজেই যাহারা মুক্তি ফৌজের শামিল হয় নাই তাহারাও যদি শঙ্কিত হয় তাহাতে আশ্চর্য হইবার কী আছে? তবে পশ্চিম-পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারে বাংলাদেশের নিরীহ বাসিন্দারা আতঙ্কিত হইলেও তাহারা নিজেদের ভিটা আঁকড়াইয়া থাকিয়া নীরবে মরিতেছে না। বাস্তুত্যাগ করিয়া তাহারা আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পার হইয়া দলে দলে ছুটিয়া আসিতেছে ভারতবর্ষে। বাংলাদেশের চার দিকে যে কয়টি ভারতীয় রাজ্য আছে তাহাদের সব কয়টিতেই শরনার্থীর ভিড় শুরু হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় কেহই বাদ যায় নাই- সর্বত্রই বাংলাদেশের ছিন্নমূল নরনারীর দল প্রাণের দায়ে আসিয়া নিরাপত্তা খুঁজিতেছে। তাহাদের মধ্যে শিশু বৃদ্ধ প্রৌঢ়ের সংখ্যাই বেশী, পুরুষের চেয়ে নারীরও। নবজাত রাষ্ট্রকে বাঁচাইয়া রাখিবার গুরু দায়িত্ব লইয়াছে তরুণ-তরুণীরা। সীমান্তে এপারে পাঠাইয়াছে যাহারা যৌবনের সীমা অতিক্রম করিয়াছে। 

এই বাস্তুহারাদের সংখ্যা যে কত তাহার সঠিক হিসাব দেওয়া বােধহয় সম্ভব নয়। লাখ তাে কবে পার হইয়া গিয়াছে, এখন সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি মনে হইতেছে, তাহার বেশি হওয়াও অসম্ভব নয় । এত শরনার্থীদের দেখাশােনা করা কিংবা আশ্রয় দেওয়া রীতমতাে কঠিন ব্যাপার। তাই বলিয়া যে দায়িত্ব এ দেশের উপর বর্তাইয়াছে তাহাকে অবহেলা করা চলে না। চরম বিপদ এড়াইতে এপারে আসিয়া শরনার্থীরা যেন আত্যন্তরে না পড়েন। বিস্তৃত সীমান্তের নানা অঞ্চলে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সাময়িক শিবির তৈয়ারী হইয়াছে। কিন্তু সেগুলির সুপরিচালনার ব্যবস্থা না করিতে পারিলে হিতে-বিপরীত হইবে। সমস্যাটা বিরাট। কিন্তু সরকার তৎপর হইলে কোনও বিশৃঙ্খলা ঘটিবার কথা নয়। যে কোনও একটি রাজ্যের পক্ষে এত বড় একটা বৃহৎ দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। তাছাড়া এ দায়িত্ব বিশেষ কোনও একটি রাজ্যের নয়পশ্চিমবাংলার নয়, আসামের নয়, ত্রিপুরার নয়, মেঘালয়ের নয়। এ দায়িত্ব সমগ্র ভারতবর্ষের প্রত্যেক রাজ্যকেই কেন্দ্রের সঙ্গে যৌথভাবে এ মহৎ কর্তব্য পালন করিতে হইবে। সীমান্তের কাছাকাছি যে সমস্ত আশ্রয়-শিবির তৈয়ারী হইয়াছে সেগুলিকে আরও অনেকদিন রাখিতে হইবে, কিন্তু শরণার্থীদের এক অঞ্চলে না রাখিয়া বিভিন্ন কেন্দ্রে রাখার বন্দোবস্ত করিতে হইবে, না হইলে হয়তাে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। যাঁহারা সীমান্তের ওপার হইতে এপারে চলিয়া আসিতেছেন তাঁহাদের মন পড়িয়া আছে ফেলিয়া-আসা গ্রামগুলিতে শহর অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত হইলেই আবার তাহারা নিজ বাসভূমে ফিরিয়া যাইবেন, ইহাই তাঁহাদের বাসনা। যতদিন সে সুদিন না আসে ততদিন যাহাতে   তাহাদের ভারত প্রবাস স্বাচ্ছন্দ্যময় হয় সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। | লজ্জার কথা, ওই বঞ্চিতদের বঞ্চনা করিবার দুপ্রবৃত্তিও লােকের আছে। জাল নােট দিয়া পাকিস্তানী নােট বিনিময়ের কথা শােনা যাইতেছে। মুনাফাবাজির অভিযোগও উঠিয়াছে। হাঙ্গরের গ্রাম হইতে আর্ত শরণার্থীদের রক্ষা করার ভার একা সরকারের নয়, আমাদের সকলের । সে কর্তব্য যদি আমরা পালন করতে পারি তাহা হইলে লজ্জা রাখিবার জায়গা আমাদের থাকিবে না।

২৪ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!